ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

শান্তিনিকেতনের সবুজ শান্তি

ইরানী বিশ্বাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:০০, অক্টোবর ৪, ২০১১
শান্তিনিকেতনের সবুজ শান্তি

১৮৪৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের ভুবন সিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রণ শেষে পালকি করে এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বোলপুরের এক জায়গায় এসে ছাতিমগাছের তলায় পালকি রেখে একটু জিরিয়ে নিলেন।

তারপর থেকে তিনি মনে মনে ভাবলেন এখানে তিনি আরো গাছ লাগাবেন। এই প্রত্যাশায় রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে এই জমি তিনি দান হিসেবে গ্রহণ করেন।

প্রথমে তিনি অনেক গাছ লাগালেন। গাছের সবুজ আর নির্জনতাকে তিনি খুব পছন্দ করলেন। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৮ সালে এখানে একতলা একটি বাড়ি তৈরি করেন। মাঝেমাঝে সাধনার জন্য এখানে চলে আসতেন।

এরও কিছুদিন পর এই একতলা বাড়িটির ওপর দোতলা নির্মিত হয়। মহর্ষি এই বাড়িতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে এর নাম রাখলেন শান্তিনিকেতন। আজকের শান্তিনিকেতনের আদি ইতিহাসটা এরকমই।

প্রথম দু বছর এ বাড়িটির দোতলায় উপাসনা অনুষ্ঠিত হতো। পরে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয় করে ব্রাহ্মমন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরটি নির্মিত হয় অভিনব কৌশলে। জানা যায়, সেকালের বিখ্যাত সিকদার কোম্পানির প্রসন্নকুমার সিকদারের তত্ত্বাবধানে লোহার ফ্রেমে বাঁধা নানা রঙের কাচে নির্মিত হয়েছে এ মন্দিরটি। এখানে উপাসনার কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই। পুরো ঘরটি ফাঁকা। কোথাও কোনো আসবাব নেই। যে কেউ যে কোনো দিকে বসে তার আরাধনা বা উপাসনা সম্পন্ন করতে পারেন।

ব্রাহ্মধর্ম মূলত একেশ্বরবাদ। এখানে ঈশ্বরকে এক ও নিরাকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এ ধর্মের অনুসারীদের মতে ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিকমুখী হওয়ার প্রয়োজন নাই।

শান্তিনিকেতনের ট্রাস্টি সদস্য রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায় তার কর্মভার ত্যাগ করলে নিয়ম অনুসারে ১৮৮৯ সালের আগস্টে সেই জায়গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ট্রাস্টি হিসেবে নিযুক্ত হন। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনের এক নতুন অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হয় শান্তিনিকেতন। আর বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে শান্তিনিকেতন এখন বিশ্বের সাহিত্যানুরাগীদের তীর্থধামে পরিণত হয়েছে।

একটানা তিন বছর কোলকাতায় বসবাসের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তাছাড়া কয়েকবার বিভিন্ন প্রয়োজনে কোলকাতায় যেতেও হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই তীর্থধামে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার প্রতিজ্ঞা করে গিয়েছিলাম, সেখানে যাবই। আমার এক বন্ধু শান্তিনিকেতনের দূরদর্শনে চাকরি করেন। তিনি জানালেন, কোলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যাবার জন্য আলাদা একটা ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। নাম শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। এটি হাওড়া থেকে বোলপুর অর্থাৎ শান্তিনিকেতন পর্যন্ত যাওয়া-আসা করে। সকাল ১০টার ট্রেনে উঠলে বোলপুর স্টেশনে পৌঁছাবে দুপুর ১২টায়। সেখান থেকে অটো/ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা শান্তিনিকেতনে যাওয়া যায়।

দুপুর ১২টার দিকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস বোলপুর স্টেশনে এসে পৌঁছাল। প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখি শান্তিনিকেতনের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আমাকে নেবার জন্য। কুশলাদি জিজ্ঞাসা শেষে গাড়িতে উঠে বসলাম। বোলপুর স্টেশন থেকে একটি রাস্তা সোজা চলে গেল দূরদর্শন ভবনের দিকে। সে রাস্তাটি খুব ভালো না। এখানকার রাস্তাঘাট দেখে শহর মনে হয় না। মনে হয় গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি।

আমরা সে রাস্তা অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম সামনে। রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট খুপড়ি দোকান। একটা বাজার আছে। এটি দেখে গ্রামের হাটের কথা মনে পড়ে গেল।

অবশেষে আমরা পৌঁছলাম শান্তিনিকেতন দূরদর্শন ভবনে। এখানে দূরদর্শন (টেলিভিশন) ছাড়াও আছে শান্তিনিকেতন বেতার কেন্দ্র। কয়েক একর জমির মধ্যে রয়েছে দূরদর্শন, বেতার ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আবাসন।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় এখানের সবুজের সমারোহ। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। দূরদর্শন ভবনের সামনে একচিলতে  বাগানে সবুজ ঘাসের বুক চিরে জেগে উঠেছে বাহারী ফুলের গাছ। কোলাহলবর্জিত দুপুরের বুক চিরে কানে ভেসে আসছে কিচিরমিচির পাখির ডাক।

একতলা বিল্ডিংয়ে আছে স্টুডিও রুম। এখান থেকে  ডিডি-২ এ শান্তিনিকেতনের সব অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। এছাড়া আছে শিল্পী কক্ষ, কলাকুশলীদের কক্ষ, মহাপরিচালকের কক্ষ ও সম্পাদনা রুমহস বেশ কয়েকটি রুম। এখানকার স্টুডিওতে রবীন্দ্রগীতিনাট্যর মঞ্চ তখনো তৈরি করা। আমার যাবার একটু আগেই এ অনুষ্ঠানটি ধারণ করা হয়েছে। আমাকে নিয়ে গেস্টহাউসে যাওয়া হলো। এখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে গাড়িতে করে রওনা হলাম আশ্রমের দিকে।

এখান থেকে যে রাস্তাটি চলে গেছে আশ্রমের দিকে সেটি খুব চওড়া না হলেও বেশ ভালো। দু পাশে সারি সারি গাছ। রাস্তার ঠিক দু পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের দুটি অধ্যায়। একপাশে বসবাসের স্থান, অন্যপাশে শিক্ষাগ্রহণের স্থান।

হাতের ডান দিকের গেটে লোক বসে আছে। মোবাইল অফ করে ক্যামেরা বা অন্যান্য জিনিস সেখানে রেখে ভেতরে প্রবশে করতে হবে। প্রবেশমূল্য ৫ রুপি। বাড়িটির ভেতরে কেন যে ছোট ছোট খোয়া বিছানো আছে ঠিক জানি না। তবে এর ওপর দিয়ে হাঁটতে বেশ মজাই লাগছিল। ঢুকতেই হাতের ডান দিকে কয়েকটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। হাতের বাঁ দিকে রবীন্দ্রনাথের উত্তরায়ণ ঘর। এটিই মূলত রবীন্দ্র মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখানে সাজানো আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র। তিনি যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তার একটি রেপ্লিকা তৈরি করে রাখা হয়েছে রবীন্দ্রভক্তদের মনোরঞ্জন করার জন্য। কারণ আসল নোবেল পদকটি চুরি হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে।

এখান থেকে একটু সামনে হেঁটে এলে আরো একটি ঘর। এ ঘরটিতে কবি লিখতেন, অতিথিদের সাথে বসে কথা বলতেন। তাছাড়া বিভিন্ন নামী-দামী কবিদের সাথে বসে সাহিত্য আলোচনা করতেন। কবি যে আসনে উপবিষ্ট হতেন, সেটি এখনো তেমনভাবেই সুরক্ষিত।

সামনের দিকে হেঁটে যেতেই চোখে পড়বে মাটির একটি ঘর। এটির নাম শ্যামলী। শান্তিনিকেতনে প্রথম যেদিন গান্ধীজী আসেন এখানে গাছের ছায়ায় গান্ধীজীর সাথে বসেছিলেন রবী›ন্দ্রনাথ। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে এ ঘরটি ইট-সিমেন্ট দিয়ে মাটির ঘরের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি সিমেন্টের গায়ে মাটির আবরণ দেওয়া হয়েছে। দেখলে মনে হবে যেন মাটির ঘর। প্রতিদিন এ ঘরে মাটিজল দিয়ে লেপন করা হয়।

এর ঠিক সামনেই একটি দোতলা বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে দেখা যাবে কবির শোবার ঘর। সামনে খোলা চওড়া বেলকনি, রেলিং দেওয়া। এখানে আরাম কেদারা বিছিয়ে  কবি প্রাতে উপাসনা করতেন, গান লিখতেন, সুর ভাঁজতেন। এমনকি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বই পড়তেন ও লেখালেখি করতেন।

গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা ডিঙিয়ে ও পাশে ঢুকতেই গাছের সমারোহ। প্রতি বছর বর্ষাকালে এখানে বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়। বিনামূল্যে শত শত গাছ বিলি করা হয়। এখানে উপস্থিত অতিথিদের প্রত্যেকেই গাছের চারা কিনে নিয়ে যান। তাছাড়া শান্তিনিকেতনে একটি গাছ কাটা হলে দুটি গাছ লাগানো হয়। বড় বড় আমগাছের ছায়ায় শান্তিনিকেতনের ক্লাস করানো হয়। এটি আম্রকুঞ্জ নামেও পরিচিত। বড় বড় গাছের নিচে ইটের তৈরি বেষ্টনীতে বসে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষালাভ করেন। কখনো কখনো রুমের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা ক্লাস করে থাকেন। শান্তিনিকেতনের সব শিক্ষার্থীর জন্যই আবাসিক ব্যবস্থা আছে।

প্রতি বছর পৌষ মাসের ৭ তারিখে এখানে মেলা হয়। এর নাম পৌষমেলা। এটি অবশ্য চালু করেছিলেন কবিপিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৭ পৌষ বৃহস্পতিবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কুড়িজন অনুরাগীসহ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। এই ধর্মের সাফল্য, প্রসার ও প্রচারে অনুপ্রাণিত হন মহর্ষি। তখন থেকেই তিনি বাসনা করেন দীক্ষিত ব্রাহ্মদের নিয়ে তিনি একটি মেলা করবেন। ১৮৬৭ সালের ৭ পৌষ থেকে এ মেলার প্রচলন হয়। মহর্ষি এ মেলার স্রষ্টা হলেও এর প্রকৃত রূপকার কবি নিজে। ব্রাহ্মধর্ম মতে বুধবার পবিত্র দিন। এ দিনে উপাসনা করলে সিদ্ধিলাভ হয়। এ কারণে শান্তিনিকেতনের আওতাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান  ছাড়া সব প্রতিষ্ঠান বুধবার বন্ধ থাকে। শনিবার ও রবিবার এখানে যথারীতি কর্মক্ষেত্র চালু থাকে।

শান্তিনিকেতনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী, খোয়াই নদী। পুরনো গল্প বা সিনেমা দেখলে এ নামটি খুব পরিচিত মনে হবে। তখনকার দিনে এটি ছিল প্রধান শুটিং প্লেস। জানা যায়, খোয়াই নদীর উৎপত্তি মূলত একটি মালভূমি থেকে। এটি মিশে গেছে ব্রক্ষ্মপুত্রের সাথে। সপ্তাহের প্রত্যেক শনিবারে খোয়াই নদীর পাড়ে একটি হাট বসে। এর নাম ‘আমাদের হাট’। এ হাটে আসেন শান্তিনিকেতনের আশপাশের নারী-পুরুষ সবাই। এর মূল উপাদান ঘরে তৈরি বস্তু। যেমন কেউ পিঠা তৈরি করে প্লেটে করে নিয়ে আসেন। কারো ঘরের চালে লাউ হয়েছে, সেটাই নিয়ে আসেন। এ হাট বসে দুপুরের পর অর্থাৎ ভাটিবেলা থেকে আরম্ভ হয়ে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত। এ হাটে কখনো কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয় না।

বোলপুরের শান্তিনিকেতন এখন বিশ্বশান্তির বার্তাবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে গেলে সত্যি মনে শান্তি আসে। এখানে না এলে হয়তো বাঙালি হিসেবে অসম্পূর্ণ থেকে যেতাম।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।