এছাড়া বাকী বাড়িগুলোর অবস্থা একেবারেই জরাজীর্ণ হওয়ায় এগুলো পরিণত হয়েছে মাদকসেবী ও জুয়াড়িদের অভয়াশ্রমে।
অনুসন্ধান ও সরেজমিনে জানা যায়, জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলুসখা গ্রামে ছিল ১৪ জন জমিদারের বাস।
তাজদিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে আরো জানান, জমিদার সতীশ কুমার রায় ছিলেন অখণ্ড ভারতবর্ষের শিক্ষাবোর্ডের ডাইরেক্টর। তার ভাই মাধব চন্দ্র রায় ছিলেন আরসিসি’র জনক। এছাড়া জমিদার প্রতাপ সিংহ রায়ের ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় ছিলেন অখণ্ড ভারতবর্ষের একজন খনিজ বিদ্যা বিশারদ। তার জানা তথ্যমতে অধিকাংশ জমিদাররাই ছিলেন শিক্ষানুরাগী। এর মধ্যে জমিদার চন্দ্র কুমার রায় ১৮৭৬ সনে “কৃষ্ণ গোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়” নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাজদিকুল ইসলাম আরো জানান, ১৪ জমিদারের মধ্যে চন্দ্র কুমার রায় ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী মনোভাবের। মহলের সামনে দিয়ে কেউ জুতা পরে যেতে পারতেন না। জুতা পরে গেলেই তাকে ধরে এনে করা হতো অত্যাচার।
সরেজমিনে জলসুখা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি ভবন। তার নাম ছিল আটচালা। স্থানীয়দের বিবরণ অনুযায়ী এ ভবনটির মালিক ছিলেন জমিদার গোবিন চন্দ্র রায়। ১৪ জমিদারের সবার চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী ছিলেন তিনি। আটচালা ভবনটিতে বৈঠক করতেন ১৪ জমিদার। ভবনটি বর্তমানে একেবারেই অরক্ষিত। সন্ধ্যার পরপরই সেখানে জুয়াড় আসর বসে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে বর্তমানে এ বাড়িটির একটি কক্ষে সরকারি ভূমি অফিস।
বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় জরাজীর্ণ একটি মহলে থাকা জমিদার পরিবারের এক বংশধর কমলেশ রায়ের। তার দাদা ক্ষেত্রনাথ রায় ছিলেন ১৪ জমিদারের একজন। ৮৫ বছর বয়সী কমলেশ আক্ষেপ করে জানান, তার বাবা ক্ষিতিশ রায় জমিদারির কিছুটা ভোগ করতে পারলেও তার জন্ম জমিদারির শেষ সময়ে। অন্যান্য জমিদাররা ভারতে চলে গেলেও তার পরিবার যায়নি। বংশধরদের মধ্যে যারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন অধিকাংশরাই বাড়ির কাজের লোকদের বিশ্বাস করে সবকিছু আমানত রেখে যান। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন সব দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাড়িতে এখনও ওইসব কাজের লোকের প্রজন্মরা বসবাস করছেন। আর কয়েকটি রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।
কমলেশ আরো জানান, তার দাদার ব্যবহৃত ভবনটি এখনও তাদের দখলে থাকলেও নেই জমিদারির কোনো নিশানা। অভাবের তাড়নায় বিক্রি করে দিয়েছেন জমিদারদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র। কিছু জিনিসপত্র অনেক কষ্টে আঁকড়ে ধরে রাখলেও সময়ের ব্যবধানে সেগুলোও চুরি হয়ে গেছে।
জলসুখা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ কাদির শামছু বাংলানিউজকে জানান, জমিদারেরা ভারতে চলে যাওয়ার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মদদে অনেক চালাক-চতুরেরা ভুয়া ওয়ারিশান সদনপত্র তৈরি করে জমিজমার কাগজ নিজের নামে করিয়ে নিয়েছেন। ওই জমিজমার দখলদার অনেকেই এখন কোটিপতি হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
জলসুখা গ্রামের হাজী আব্দুল হাশিম বাংলানিউজকে জানান, ১৮ শতকের কোনো এক সময় জমিদার বৈকুণ্ঠ রায়ের বাবা দুলগোবিন্দ রায়ের বাড়িতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা পালনকারী লর্ড ক্লাইভ এসেছিলেন। এখানে এক রাত্রি যাপন করেছিলেন তিনি। তখনকার সময়েই তার আপ্যায়নে প্রচুর পরিমাণে টাকা ব্যয় করেছিলেন দুলগোবিন্দ রায়। জানা যায়, এই জমিদার বাড়িটিতে সেসময় ঘেটু নৃত্য পরিবেশিত হতো।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সাবেক উপ সচিব ড. শেখ ফজলে এলাহী বাংলানিউজকে জানান, জলসুখা এলাকায় ১৪ জন জমিদারের বাস ছিল এটা সঠিক। এর মধ্যে দুয়েকজন ছিলেন খুব প্রভাবশালী। জমিদার বৈকুণ্ঠ দাশের বাড়িতে শ্রীহট্ট সম্মিলনীর ৩য় অধিবেশন বসেছিল। এই সম্মিলনীতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঋষি অরবিন্দ। স্থানীয় ওয়ারিশ মিয়া নামে একজন বাংলানিউজকে বলেন, অনেকদিন আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ জমিদার বাড়িগুলো দেখতে ভীড় করতেন পর্যটকরা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এগুলো একেবারেই অরক্ষিত হয়ে গেছে। তাই বাড়িগুলো দেখতে আর কেউ আসেন না।
তিনি আরো বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ জমিদার বাড়িগুলোকে সংরক্ষণ করা হলে আবারো ফিরে পাবে পুরোনো আকর্ষণ। জমিদারদের ব্যবহৃত এ ভবনগুলোকে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
এ ব্যাপারে আজমিরীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পুলক কান্তি চক্রবর্তী বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি আমি এখানে যোগদান করেছি। বাড়িগুলো সম্পর্কে জানা নেই। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৮
আরএ