এক যুগ আগেও পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এ সময়টাতে দম ফেলার ফুরসত ছিল না তাঁর মতো কুমারদের। কাকডাকা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলতো কর্মযজ্ঞ।
কিন্তু এসব যেন এখন শ্যামলের কাছে স্মৃতিময় এক দীর্ঘশ্বাস। দিন বদলের পালায় মাটির তৈরি থালা, হাঁড়িপাতিল, বাসনকোসনের প্রয়োজনীয়তাও যেন ফুরিয়েছে।
সেই জায়গাটা নিয়েছে প্লাস্টিক, সিলভার, ম্যালামাইন ও চিনামাটির সামগ্রী। ফলে বাংলা নববর্ষ দরজায় কড়া নাড়লেও প্রাণচাঞ্চল্য নেই পালপাড়ায়। ব্যস্ততা নেই শ্যামলদেরও।
বছরের অন্য সময় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের কদর না থাকায় পালপাড়ার কুমারদের বেশিরভাগই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আবার বংশ পরম্পরায় শ্যামল চন্দ্র পালের মতো কেউ কেউ কাদামাটি দিয়ে শিল্পের এ চর্চাটা এখনো ধরে রেখেছেন।
বেজার মুখে শ্যামল চন্দ্র পাল বাংলানিউজকে বললেন, পহেলা বৈশাখে গ্রামীণ মেলার ঐতিহ্যই হচ্ছে মাটির এসব খেলনা ও তৈজসপাতি। এ সময় এসব জিনিসপত্রের চাহিদিও থাকে তুঙ্গে।
বাদবাকি সময় কেউ এদিকটায় ফিরেও তাকায় না। তখন মৃৎশিল্পীদের একেকজন একেক কর্মের মাধ্যমে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। নতুন প্রজন্ম এ পেশার প্রতি আগ্রহী না।
চৈত্রের কড়া রোদের মধ্যে রোববার (০৮ এপ্রিল) দুপুরে নগরীর কৃষ্টপুর আলীয়া মাদ্রাসার পেছনে পালপাড়ায় আলাপ হচ্ছিল মৃৎশিল্পী শ্যামল চন্দ্র পালের সঙ্গে।
এ পালপাড়ায় জনা পঞ্চাশেক পরিবার বাস করলেও কেবল শ্যামল চন্দ্র পাল ও তার ভাই সকলী চন্দ্র পাল বাপ-দাদা’র এ পেশাটা ধরে রেখেছেন।
আলাপের সময় ঘরের দূয়ারে বসে দক্ষ এ মৃৎশিল্পী নিপুণ হাতে মাটির তৈরি বাহারি ফুলদানি, হাতি, ঘোড়া, গরু, পাখি, পুতুল, ব্যাংক, তরমুজ, পেঁপে, আঙুর, কলা, আপেলসহ বিভিন্ন মাটির খেলনা তৈরি করছিলেন।
পাশাপাশি রং-তুলি’র আঁচড় দিচ্ছিলেন। বৈশাখী মেলায় ছোট শিশুদের এসব খেলনা কিনে দিয়ে মন ভরাবেন তাদের অভিভাবকরা।
মাটির তৈরি এসব সামগ্রী নিজে শহরের উম্মেদ আলী, জয়নুল উদ্যান ও আকুয়া ভূঁইয়া বাড়ি মাঠের বৈশাখী মেলায় বিক্রি করবেন বলে জানান শ্যামল।
‘‘এক সময় পাইকাররা বৈশাখের আগে আমাদের এখানে ভিড় করতো। কিন্তু এখন পাইকাররা ভুলেও পালপাড়ায় আসে না। আমি নিজেই এসব তৈরি করে নিজেই বিক্রি করি। ’’—বলছিলেন তিনি।
শ্যামলের সঙ্গে আলাপের সময়েই ‘‘পালপাড়ায় আর থাকবো না। মাটির কাজ উঠে গেছে’’ বলে হাঁক দিলেন তাঁর ছোট ভাই স্বর্ণশিল্পী রিপন চন্দ্র পাল (২৮)।
পালপাড়ার এমন দুরাবস্থার কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, এখন চাহিদামতো আঁঠালো মাটিও পাওয়া যায় না। দূর গ্রাম থেকে মাটি আনতে হয়। এজন্য ঠেলাগাড়ির ভাড়াই দিতে হয় ৫’শ থেকে ৬’শ টাকা। তাছাড়া এখানে আগুনে পুড়িয়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্রগুলো শক্ত করতে প্রয়োজনীয় ‘পুণ’ও (মাটির চূলা) তৈরি করা যায় না।
রংসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও চড়া। আবার বাজারেও এসব জিনিসপত্রের চাহিদা নেই। ভালো দামও মেলে না। ফলে পুরনো পেশা ত্যাগ করে শ্রমিক বা স্বর্ণকারের কাজ করেন।
শ্যামল চন্দ্রের মতো শুধু বৈশাখী সময়টাতে এ পেশায় মনোনিবেশ করেন সকীল চন্দ্র পাল (৫০)। একজন মৃৎশিল্পী হিসেবে নিখুঁত অভিব্যক্তিতে তিনি তখন ফুটিয়ে তুলছিলেন মাটির তৈরি খেলনার নানা আকৃতি।
পাশের কক্ষেই তাঁর সঙ্গে রঙতুলি নিয়ে খানিকটা ব্যস্ত সময় পার করছিলেন স্ত্রী সারথী রাণী পাল (৩৫) ও ছোট ছেলে গোপাল চন্দ্র পাল (৯)।
আলাপচারিতায় মৃৎশিল্পী সকীল চন্দ্র পাল বাংলানিউজকে বলছিলেন, কাদামাটির এ শিল্প এখন বিলীন হবার পথে। পুরো পালপাড়ায় শুধু আমরাই বৈশাখে মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া-পুতুলসহ বাহারি তৈজসপত্র তৈরি করি।
কিছুটা বেচাবিক্রি হয়। তবে এ পেশায় জীবন ধারণ করার মতো স্বচ্ছলতা নেই। ফলে বৈশাখেও পালপাড়ায় পাইকারদের আনাগোনা নেই। হারিয়ে গেছে প্রাণচাঞ্চল্যও।
স্থানীয় আলীয়া মাদ্রাসা রোডের পেছনের এ পালপাড়ার চেয়েও নীরব স্থানীয় বলাশপুর পালপাড়া। এ পালপাড়ায় প্রায় শতাধিক পরিবার বাস করলেও তাদের কেউই আর এ পেশার সঙ্গে নেই।
এ পালপাড়ার বাসিন্দা এক সময়কার মৃৎশিল্পী নগেন্দ্র চন্দ্র পাল (৬৫) জানান, শারদোৎসবের সময় প্রতিমা তৈরির কাজ করেন কেউ কেউ। কিন্তু পহেলা বৈশাখের মাটির তৈরি সামগ্রী বানানোর চর্চা নেই কোনো পরিবারেই। ’
তবে কাদামাটির এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন ময়মনসিংহের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের রেক্টর অধ্যাপক আমির আহম্মেদ চৌধুরী রতন।
তিনি বলেন, দেশীয় কৃষ্টি আর স্বকীয়তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মাটির বাসন কোসন। সরকার এদিকে নজর না দিলে একদিন এ শিল্প পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৮
এমএএএম/জেএম