তাই তালের পাখাকে বলা হয় মানুষের প্রাণের সখা। প্রাচীন লোকগাঁথাতে প্রবাদ আছে “আমার নাম তালের পাখা শীতকালে দেইনা দেখা, গ্রীষ্মকালে প্রাণের সখা”।
বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা এলেই অন্যতম প্রধান একটি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় তালপাখা। তাই বর্ষবরণকে সামনে রেখে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ধুম লেগেছে তালপাখা তৈরির।
কেউ তালের পাতা কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন, কেউ সুতা ও বাঁশের শলাতে রং করছেন। কেউ পাখার বোঝা বাঁধছেন। এ যেন এক অন্যরকম কর্মযজ্ঞ। কাজের ব্যস্ততায় শরীরের ঘাম মাটিতে পড়লেও নিজেদের তৈরি এসব পাখার বাতাস নেওয়ার যেন সময় নেই তাদের।
নাটোর শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের হাঁপানিয়া গ্রামটিতে তালগাছ না থাকলেও এখন তালপাখার গ্রাম নামেই পরিচিত। শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি আর মমতার বুননে হাতে তৈরি তালপাখাই জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানকার মানুষদের। বছরের ছয়টি মাসে হাতপাখা তৈরি করে বাড়তি উপার্জন করছেন শতাধিক পরিবার।
তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ সুবিধা না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ গ্রামের অসচ্ছল কারিগরদের জীবনমান উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা দেওয়াসহ স্বল্প সুদে আর্থিক ঋণের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ছোট-বড় সবাই তৈরি করছেন তালপাখা। কারিগররা জানান, পৌষ মাসের শুরুতে তারা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রধান কাঁচামাল ডাগুরসহ তালপাতা কিনে আনেন। প্রতিটি পাতা ডাগুরসহ কিনতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা। ডাগুরগুলোকে পাখার আকারে গোল করে কেটে রোদে শুকানোর পর পাখা তৈরি করা হয়।
প্রতিটি পাখায় গড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা খরচ পড়ে। পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ১২ থেকে ১৫ টাকায়। এ পেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে কাজ করছে।
তবে মজুরি একেবারেই কম। একশ’ পিস পাখা তৈরি করলে মজুরি পাওয়া যায় ৩৫ টাকা। ৩ থেকে ৫ জন নারী একসঙ্গে বসলে ঘণ্টায় ৩০০টি পাখা অনায়াসে তৈরি করা যায়। রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তালপাখার চাহিদা মিটায় হাঁপানিয়ার তালপাখা।
ষাটোর্ধ্ব বয়সী বৃদ্ধা সবেজান বেগম জানান, এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে শুরু করে এখনও তালপাখা তৈরি করে যাচ্ছেন তিনি। তালপাখা তৈরি করেই সন্তানদের মানুষ করেছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার পুত্রবধূও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করেন।
বৃদ্ধ আলাউদ্দীন ও সফেদ মণ্ডল জানান, চারদশক ধরে তালপাখাই তাদের জীবিকার উৎস। দীর্ঘসময়ে সরকারি কোনো সহায়তা বা ঋণ পাননি। পাখার চাহিদা বরাবরই বেশি। ঋণ পেলে আরো বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব।
পাখা প্রস্তুতকারী মুনসুর আলী বলেন, তালপাখা তাদের অল্প বয়সেই আত্মনির্ভর করেছে। তবে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অনেককে সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া নিজস্ব পুঁজি কম থাকায় কোনো কারিগরের পক্ষে বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব হয় না।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, আত্মনির্ভর এ ধরনের উদ্যোগকে প্রসারিত করতে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধাও দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৮
আরএ