ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

১২৫তম জন্মবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রবীর বিকাশ সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৩০, নভেম্বর ১২, ২০১১
১২৫তম জন্মবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঊষালগ্নে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের অন্যতম হলেন প্রবীণ আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং মন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ২৭ মার্চ গভীর রাতে বোমা ফাটিয়ে পাক বাহিনীর কতিপয় সেনা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে অমানুষিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সেই ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী একজন নাপিত বর্ণনা করেছেন। স্বাধীনতার পর তাঁর কাপড় ও হাড়গোড় দেখে তাঁর মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

বড় ছেলে সঞ্জীব দত্ত ছিলেন স্বনামধন্য সাংবাদিক। নিরাপত্তাহীনতার কারণে আগেই পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। ধীরেন দত্তর নাতনী ও নাতি আরমা ও ছেলে রাহুল সেদিনই পালিয়ে অন্য জায়গায় ছিলেন বলে রক্ষা পেয়েছিল। তবে তাঁর ছোট ছেলে দীলিপ দত্তকেও পাকসেনারা হত্যা করে।

সঞ্জীব দত্তর স্ত্রী প্রতীতি দত্ত দু সন্তানকে নিয়ে বহু কষ্ট ও বিড়াম্বনা সহ্য করে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছতে সক্ষম হন এবং মিলিত হন স্বামীর সঙ্গে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা ফিরে আসেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আমার বয়স ১০-১১ বছর। একাত্তরে ১২। কৈশোরে কুমিল্লার ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুলে পড়তাম। থাকতাম ছোটরা সরকারি কলোনির কাছে। সেখান থেকে প্রতিদিন ধর্মসাগর দিঘির পশ্চিম পাড় ধরে স্কুলে যেতাম। তখন ধীরেন দত্তকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর বাড়ির বারান্দায়, কখনোবা ফটকের কাছে পায়চারি করতে। রাহুল ছিল আমাদের সমবয়সী।
স্বাধীনতার পর যখন ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ে বাবা যখন বাসা নিলেন তখন রাহুল একেবারে ভিন্ন ছেলে। মানসিকভাবে অসুস্থ। সারাদিনই জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের হাতের ইশারায় ডাকত, কখনোবা গান করত। তার কণ্ঠস্বরও বদলে গিয়েছিল। আমরা জানতে পারলাম তার ঠার্কুদার নির্মম মৃত্যু, কাকারও অবর্ণনীয় মৃত্যুর আঘাত তার মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। যা সে আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আরমাদি তাকে নিয়ে গিয়েছেন ভারতে ও জার্মানিতে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু নিরাময় হয়ে ওঠেনি সে।

রাহুল হয়ে গেল চিরদিনের জন্য একা। সংসারে এক মা আর দিদি, তাদের ওপরই সে নির্ভরশীল। অথচ সে মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে একজন বড় মাপের সৃজনশীল মানুষ হতে পারত বলে আমার বিশ্বাস। মানসিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তার অসম্ভব সিনেমাপ্রীতি আমাদের বিস্মিত করেছে ছেলেবেলায়। [আমি ‘রাহুল’ নামের একটি ফিকশনে লিখেছি : এত বড় খ্যাতিমান একটি পরিবারে তার জন্ম, নাড়িজুড়ে প্রবাহিত পিতৃ-মাতৃকুলের একাধিক মেধাবী মানুষের রক্ত, সেই রাহুল এই বিষয়ে কোনোদিন গর্ব করা দূরে থাক, কোনো কিছুই বলত না। আমি অনেকবার তাকে জিজ্ঞেস করেও একমাত্র নীরবতা ছাড়া আর কোনো উত্তর পাইনি। পিতৃকুলে ধীরেন্দ্রনাথ, সঞ্জীব দত্ত আর মাতৃকুলে দাদুঠাকুর সুরেশচন্দ্র ঘটক ছিলেন ব্রিটিশ যুগে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট; বড়মামা কল্লোল যুগের কবি ও প্রগতিশীল লেখক অধ্যাপক মণীশ ঘটক, বড় মামী লেখিকা ধরিত্রী দেবী, মামাত বোন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও সমাজসেবী মহাশ্বেতা দেবী; ছোটমামা চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক। রাহুলের মা প্রতীতি দেবী আর ঋত্বিক ঘটক যমজ ভাইবোন। আরমাদি ও রাহুল এই দুই ভাইবোন সেই শিক্ষাই পেয়েছে পরিবারে যে, কখনো নিজেদের বংশ নিয়ে কথা না বলা, অহঙ্কার পরিহার করা। আরমাদি পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘তিনি বরাবরই অঙ্কে দুর্বল ছিলেন। ঠাকুরদা দুষ্টুমি করে বলতেন, পরীক্ষায় হংসডিম্ব পাও ক্ষতি নেই, হংসডিম্ব পাওয়া আর মানুষ হওয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ হওয়াটাই বড় কথা। ’ কী অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি!]
 
বংশগত কারণেই রাহুল সেই শৈশব থেকেই সিনেমা তথা সংস্কৃতির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট। কতবার সে আমাদের গান শুনিয়েছে ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট কন্ঠে। বাংলা, হিন্দি, উর্দু আর ওয়েস্টার্ন ছবির পাগল সে। সংগ্রহ করত জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, নায়ক-নায়িকাদের ছবি। সাধারণ বেশবাসই সে পছন্দ করত। এত সাধারণ ছিল তাদের চালচলন যে সাধারণ মানুষ থেকে তাদের পরিবারকে আলাদা করা মুশকিল ছিল। তার বড়দি আরমাদিও সংস্কৃতিমনা। কাকা শহীদ দীলিপ দত্তও ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ’

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলতে গেলে বর্তমান প্রজন্মগুলোর কাছে বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। তাঁর কোনো স্মারকমূর্তি যেমন নেই, নেই কোনো স্মৃতিসদন, যা হতেই পারত রাষ্ট্রীয়ভাবে। শুকনো মুখে নেতারা তাঁকে শুধু স্মরণ করেন, তাও যখন মনে পড়ে। দায়সারা গোছের বক্তৃতা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। শ্রদ্ধার অশ্রু দিয়ে হৃদয় ভিজিয়ে তাঁকে অনুভব করার চেষ্টা করেন না। অথচ আদর্শ এবং অকুতোভয় রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর সংগ্রামী জীবন থেকে আজকের প্রজন্ম শিক্ষালাভ করতে পারে নির্মল, বলিষ্ঠ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সংসদীয় অধিবেশনে তিনিই প্রথম দাবি করে বলেছিলেন, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত বাংলা। এই কারণে তাঁকে অনেকেই বর্তমান ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের আদি-পিতা বলেও মনে করেন। ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের চার বছর আগেই তিনি এই সাহসী উচ্চারণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।  

তাঁর মৃত্যুর পর শুধু একটি কাজই হয়েছে। কবিবন্ধু মিনার মনসুর উদ্যোগ নিয়ে একটি স্মৃতি সংসদ গঠন করে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৯৪ সালে। আমার সম্পাদিত মাসিক ‘মানচিত্র’ কাগজে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি সচিত্র ফিচার প্রকাশ করেছিলাম। এটা লিখেছিলেন তাঁদের প্রতিবেশী মঞ্জরুল আজিম পলাশ, তখন তিনি মানচিত্রের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন।  

এ বছর ধীরেন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু কোথাও তেমন আলোচনা চোখে পড়ল না। দিবসটি নীরবেই চলে গেল মনে হচ্ছে। ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর  ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য এ উপলক্ষে এ বছরের প্রথম দিকে আমি একটি ফিকশন লিখি রাহুলকে নিয়ে। ‘রাহুল’ নামে সেটা কানাডার অনলাইন ম্যাগাজিন নতুন দেশ-এ প্রকাশিত হয়েছিল। রাহুলের ঠার্কুদাকে নিয়ে কিছু না কিছু লেখা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শিকার রাহুলকে নিয়ে কিছুই লেখা হয়নি। ফিকশন হলেও রাহুলের নামের সঙ্গে, তার অজানা স্মৃতির সঙ্গে বাঙালি জাতির একজন অবিসংবাদিত অসাম্প্রদায়িক জাতীয় নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বেঁচে থাকবেন এটাই মনে করেছি।

লেখক জাপান প্রবাসী গবেষক
probirsrkr06@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।