প্রতাপ চন্দ্র রায় লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের কাজিচওড়া গ্রামের বাসিন্দা। ভূমিহীন এ মুক্তিযোদ্ধা ওই গ্রামের মৃত নেপাল চন্দ্রের বসত বাড়িতে শৈশব থেকেই আশ্রিত থাকেন।
মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায় বাংলানিউজকে বলেন, জন্মের ৬/৭ বছরের মাথায় বাবা-মাকে হারায়। তাদের মৃত্যুর পর একমাত্র সম্বল বসত ঘরটিও তিস্তার স্রোতে ভেসে যায়। এরপর ভবঘুরের মতো আমি এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকি। এরপর লালমনিরহাট সদর উপজেলার কাজিরচওড়া গ্রামের নেপাল চন্দ্র আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখান থেকেই আজ অবধি অামি এখানেই রয়েছি।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সে সময় গ্রামের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে ও পাখির মত গ্রামের নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করতো পাকিস্তানী হায়েনার দল। মা-বোনদের টেনে হেঁচড়ে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করতো তারা। এসব দেখে আমি ছুটে যায় ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখানে অস্ত্র চালানো ও যুদ্ধের কৌশল আয়ত্ত করি। এরপর দেশে ফিরে ৭নং সেক্টরে কমান্ডার নজরুল ইসলাম হাজীর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। দেশের অভ্যন্তরে দুই মাস যুদ্ধ করেছিলাম। এরপর দেশ হানাদার মুক্ত হয়।
দেশ স্বাধীনের পর ছুটে যাই বিপদের আশ্রয় দাতা পিতৃতুল্য নেপাল চন্দ্রের কাছে। এরপর বেঁচে থাকার তাগিদে ফেরিওয়ালা হিসেবে স্বাধীন দেশে জীবিকার পথ খুঁজে পাই। আশ্রিত হলেও নিজের সন্তানের মতই আমার বিয়ের আয়োজন করেন নেপাল চন্দ্র। পাশ্ববর্তী বেমালা দেবীকে স্ত্রী হিসেবে ঘরে নিয়ে আসি। নেপালের মৃত্যুর পর এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীসহ সংসারের দায়িত্ব চেপে বসে আমার কাঁধে।
প্রতাপ চন্দ্র বলেন, আগে কাঁধে করে পণ্য নিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতাম। এখন বাইসাইকেল চালিয়ে ফেরি করি। এতে দৈনিক দেড় থেকে দুইশত টাকা অায় হয়। এই টাকা দিয়েই সংসার চলে।
তিনি আরও বলেন, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা দিচ্ছে শুনে কাগজপত্র নিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছি। কিন্তু কেউ তাকে ভাতার ব্যবস্থা করেননি। সম্মানী এ ভাতার জন্য গত বছর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা বাছাই কমিটিতে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। জীবনের শেষ সময় কার দারস্থ হবেন- এ প্রশ্ন তাকে দিনদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এজন্য জীবনের শেষ মুহুর্তে হলেও স্ত্রীর জন্য মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতাটা দেখে চাই।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের লাল মুক্তিবার্তা মতে তার ক্রমিক নং ৩১৪০১০৪৩৬। ২০০৫ সালের ৩০ মে প্রকাশিত বেসামরিক গেজেটের ৫১৪৫ নং পৃষ্ঠার ৪৯৭ নম্বরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রয়েছেন প্রতাপ চন্দ্র রায়। লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ৩৩৪ নং ভোটার তিনি। সবদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি রয়েছে তার। নেই শুধু সরকারি সম্মানী ভাতাটুকু।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাপ্টিবাড়ি এলাকার এক স্কুলশিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা টাকার বিনিময়ে সরকারি ভাতা ভোগ করছেন। অথচ প্রতাপ মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ভাতা পাচ্ছেন না। উন্নয়নশীল দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করা স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জাজনক। দ্রুত তাকে সম্মানী ভাতার আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
হারাটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক বাংলানিউজকে জানান, প্রতাপ চন্দ্র রায় একজন মুক্তিযোদ্ধা। ভাতা না পাওয়ার কারণ তার জানা নেই। তবে তাকে ভাতার আওতায় আনা খুবই প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৮ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৮
এনটি