‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া...’
লিখতেন আমসত্ত্ব দুধ আর সন্দেশ আর খেতেন নিমপাতার শরবত। না, শুধু নিমপাতার শরবত নয়, বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যসৃষ্টিতে যেমন তাঁর নেশা ছিল, ঠিক তেমনই খাদ্যরসিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মাত্র ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। তারপর সারা জীবন ধরে বহু দেশ ঘুরেছেন। আর প্রতিটি দেশের ভালো লাগা খাবারগুলো সময়-সুযোগমতো ঠাকুরবাড়ির হেঁসেলে চালু করে দিতেন কবি। যেমন ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ডিশের একটি ফ্রুট স্যালাড ঠাকুরবাড়িতে চালু করেছিলেন তিনি।
একটা সময় ছিল যখন ঠাকুরবাড়িতে সবাইকে নিয়ে কবিগুরু একসঙ্গে খেতে বসতেন। কবি জাপানি চা পছন্দ করতেন কেবল তা-ই নয়, সঙ্গে তাদের চা খাওয়ার রেওয়াজটিও ছিল তাঁর পছন্দের। তাই তিনি জাপানে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তার জন্য ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করতেন গুণমুগ্ধরা।
১৯১৩ কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগের বছর ১৯১২ সালে লন্ডনে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওই দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্য তালিকা হয়েছিল কবির পছন্দে।
এই খাবারের তালিকায় ছিল : গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস এ্যান্ড কিউকামবার, প্রি সলটেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম।
বাইরে এই ধরনের খাবার খেলেও বাড়িতে তিনি কম তেল-মশলাযুক্ত খাবার খেতেন।
কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন।
ঠাকুরবাড়িতে প্রায়শই খামখেয়ালি সভা বসত। সেই সভায় কবি থাকতেন মধ্যমণি। সেই খামখেয়ালিপনা থেকেই হয়তো তিনি রাত দুটোর সময় মৃণালিনী দেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন। শোনা যায় এই ঘটনা প্রায়শই ঘটত আর মাঝরাতে মৃণালিনী দেবী রান্না করে রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াতেন।
কবি দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি।
এছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব নোসি।
কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর। সেখানে রয়েছে তার ব্যবহৃত একটি চুলা, আর বেশ কিছু চিনামাটির বাসন।
কবি কাঁচা আম খেতে ভালবাসতেন। আচারও খেতেন। কাদম্বরী দেবী কবিকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁচা আম এনে দিতেন।
এখানেই শেষ নয়, কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। তার নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালিনী তাঁকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও ঠকুরবাড়িতে রক্ষিত আছে।
ঠাকুরবাড়ির রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হতো। রান্নার তালিকায় প্রতিদিনই দীর্ঘ পদ থাকত। আর তাতে নিয়মিত অবশ্যই থাকত সুক্তো আর দইমাছ।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১১