ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

শতবর্ষী এক জাপানি রবীন্দ্রগবেষক

প্রবীর বিকাশ সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১৮, নভেম্বর ১৪, ২০১১
শতবর্ষী এক জাপানি রবীন্দ্রগবেষক

এ বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন ১৫০তম জন্মবার্ষিকী, তেমনি একজন জাপানি রবীন্দ্রভক্তেরও ১০০তম জন্মবার্ষিকী তিনি হলেন ডা. হিনোহারা শিগেআকি, ১৯১১ সালে যার জন্ম ইয়ামাগুচি-প্রিফেকচারে, অর্থাৎ মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২)।

এ যুগে জন্ম দুজন বিরল মানুষের হাত স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।

একজন শিক্ষক, সাংবাদিক এবং রাজনীতি গবেষক তানাকা মাসাআকি, যার জন্ম ১৯১১ সালে এবং মৃত্যু ২০০৬ সালে। তিনি ছিলেন টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালখ্যাত বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পালের পুত্রবৎ শিষ্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু। আর দ্বিতীয় জন হলেন উপরোক্ত ডা. হিনোহারা। ডা. হিনোহারা জাপানের সবচেয়ে নন্দিত এবং বিশ্বের সবচে দীর্ঘায়ু সুস্থ সচল চিকিৎসক হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর কর্মস্থল সেইন্ট লিউক ইন্টারশ্যানাল হসপিটাল। এটি উচ্চমানসম্পন্ন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হিসেবেও জাপানে বিখ্যাত। বর্তমানে তিনি এই হাসপাতালের সাম্মানিক চেয়ারম্যান। ২০০৫ সালে জাপানি রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত ডা. হিনোহারা তাঁর ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘ইকি কাতা জোওজুউ’ বা ‘যথার্থ বেঁচে থাকা’ বইটির ১.২ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। জীবনে কত বক্তৃতা দিয়েছেন তার হিসেব নেই। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাঁর বক্তৃতার পরিকল্পনা নির্ধারিত হয়ে আছে বলে জানালেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানী হয়েও তিনি নিয়মিত লিখে চলেছেন। তিনি এককভাবে ১১৩টি, যৌথভাবে ৭১টি এবং ১২টি অনুবাদ গ্রন্থের রচয়িতা। জাপান ইউনিসেফ অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ দূতসহ ৪০টি সংস্থার চেয়ারম্যান, পরিচালক, সাম্মানিক সদস্যের পদ অলঙ্কৃত করে আছেন এই বিরল মানুষটি।  

ডা. হিনোহারার ভাষায়, ১৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রথম পাঠ করার সুযোগ লাভ করেন। সেই থেকেই রবীন্দ্রভক্ত তিনি। বিগত ৮৩ বছর ধরে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গবেষণা করে আসছেন। এরই প্রমাণ মিলল গত ১৪ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্র সার্ধজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে টোকিওর ভারতীয় দূতাবাসে আয়োজিত ‘জাপান এবং ভারতের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের পুরোহিত রবীন্দ্রনাথের জীবন ধরে’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠের মধ্য দিয়ে। কী নিয়ে আলোচনা করেননি তিনি! প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে রবীন্দ্রজীবনের ছেলেবেলা, সাহিত্যচর্চা, স্বাদেশিকতা, শিক্ষা সংস্কার, প্রকৃতিবন্দনা, আন্তর্জাতিকতাবাদ, আধ্যাত্মিকতা, ধর্মচিন্তা, ব্রহ্মজ্ঞান, সঙ্গীতসাধনা, শিল্পকলাচর্চা তাঁর আলোচনায় সংক্ষিপ্তভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ডা. হিনোহারাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন ও মৃত্যুভাবনা’ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তিনি ব্যক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘মৃত্যুহীন জীবন অসম্পূর্ণ। ’

তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তাকে ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন খ্যাতিমান জাপানি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোরিমোতো তাৎসুও (৮০)। আমি তাঁর মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করি। অধ্যাপক মোরিমোতো গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ স্রষ্টা তথা ঈশ্বরকে ‘জীবনদেবতা’, কখনোবা ‘তুমি’, কখনো বা ‘বন্ধু’, কখনোবা ‘প্রভু’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। সৃষ্টিকর্তাকে এই ধরনের অভিধায় অভিহিত করা খুবই ব্যতিক্রম। ’

ডা. হিনোহারা আরও বলেন, ‘আমি বিগত ১৬ বছর ধরে অধ্যাপক মোরিমোতোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করছি। নতুন করে উপলদ্ধি করছি কবিকে। ১৯১৩ সালে এশিয়ায় প্রথম নোবেল অর্জনের পর তাঁকে ঘিরে জাপানি সমাজে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়! জাপানের সর্বস্তরের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে জাপানে সংবর্ধনা জানাতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। আমন্ত্রণ পাঠানো সত্ত্বেও কবির সময় হচ্ছিল না জাপানে আগমনের। ১৯১৬ সালে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়। জাপানে কবির আগমন, বিপুল সংবর্ধনা লাভ এবং ইয়োকোহামার সিল্ক ব্যবসায়ী হারা তোমিতারোর বাগানবাড়ি ‘সানকেইএন’-এ প্রায় তিন মাস অবস্থান জাপানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন মহান হৃদয়ের বন্ধুবৎসল মানুষ। জাপানে এসেই তিনি ইবারাকি-প্রিফেকচারস্থ ইজুরা নামক শহরে অবস্থিত বন্ধুবর ওকাকুরা তেনশিনের বাড়িতে তাঁর বিধবা পত্নী মোতোকো ওকাকুরা এবং স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কবির এক বছরের ছোটো ওকাকুরা তেনশিন ১৯১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন, যে বছর কবি নোবেল পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত হন। ওকাকুরা নির্মিত সুবিখ্যাত ‘রোক্কাকুদোও’ বা ‘ছয়কোণবিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ কুঠুরি’ও পরিদর্শন করে বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। ’
 
ডা. হিনোহারা আমাদের জানান যে, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন কলকাতা থেকে জাপানি যাত্রীবাহী জাহাজ তোসামারুতে চড়ে জাপানে আসছিলেন তখন জাহাজে বসে একটি হাঁসের চিত্র এঁকেছিলেন। অসাধারণ সেই চিত্র! রবীন্দ্রনাথের তিনটি চিত্র আমি ১৯৮৮ সালে জাপানে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে শান্তিনিকেতনের আম্রকানন, আত্মপ্রতিকৃতি এবং বাংলার নারী। তাঁর নিজের মুখাবয়ব এত চমৎকার এবং নিখুঁতভাবে এঁকেছেন যে, ভালো না লেগে উপায় নেই। তাঁর দীর্ঘ নাকটি দেখার মতো। এরপর বাংলার কয়েকজন নারীকে বিভিন্ন কোণ থেকে এঁকেছেন। এটা গভীর ছাপ ফেলেছে আমার মনে। রবীন্দ্রনাথ জাপানে এসে প্রথম যে কবিতাটি রচনা করেন সেটি ছোট্ট একটি কবিতা নাম ‘হোতারু’ অর্থাৎ ‘জোনাকি। ’ তিনি হাইকু কবি মাৎসুও বাশোর হাইকু কবিতার প্রশংসা করে অনুবাদও করেছেন বাংলা ভাষায়। সানকেইএন বাগানবাড়িতে অবস্থানকালে আরেকটি ছোট্ট কবিতা লিখেন ‘স্ট্রে বার্ড’ বা ‘বিভ্রান্ত পাখি’ নামে। তাছাড়া তাঁর জাপান ভ্রমণ কাহিনী ‘জাপান যাত্রী’ দু  দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জন্যই একটি অমূল্য স্মৃতিকথা। ’
রবীন্দ্র গবেষক ডা. হিনোহারা খুব গুরুত্বসহকারে বলেন যে, ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা দার্শনিক। তাই শিশুকালেই মাত্র ৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে দীর্ঘ কবিতা লিখতে সক্ষম হন যা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শিশুকালের ভিতর দিয়ে তিনি একটি মানুষের পরিপূর্ণ ত্রিকাল জন্মপূর্ব, জন্মপর্ব এবং মৃত্যুপর্বকে অবলোকন করে ফেলেছিলেন। মৃত্যুকে তিনি কখনই ভয় পাননি, বরং একে ‘শ্যাম’ বা ‘দেবতা’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটা খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। মৃত্যুকে ‘বন্ধু’ও বলেছেন। তিনি এতই মনোবলের অধিকারী এবং আশাবাদী ছিলেন যে, স্ত্রী, কন্যা, পুত্র এবং দৌহিত্রী পর্যন্ত একে একে তাঁকে ছেড়ে পরলোকে চলে যাওয়ার পরও মনোবল হারাননি। তিনি শোক অনুভব করলেও শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েননি। ’

ডা. হিনোহারা বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মসমাজে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর ব্রহ্মজ্ঞান বহু অর্থে বৈচিত্র্যময়। তাঁর ধর্মচিন্তার মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সিক, ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম প্রায় সব ধর্মের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। বিশ্বজনীনতার সুর তাঁর ব্রহ্মচর্চায় উদ্ভাসিত। তাই তিনি বিশ্বব্যাপী সর্বধর্মের মানুষের কাছে আজও গ্রহণযোগ্য মহান একজন মানুষ। তিনি যে দেশেই গেছেন নিবিষ্ট মনে সে দেশের সংস্কৃতিকে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন। তাই তার সঙ্গীত এত সমৃদ্ধ। তাঁর গান এবং সুর চিকিৎসকদের জন্য সুচিকিৎসার মাধ্যম। ’  

শতবর্ষী রবীন্দ্র গবেষক ডা. হিনোহারা যদিওবা নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচনা করেননি কিন্তু তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থে রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারেও রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রদর্শন তাঁর চিকিৎসাধর্মকেও যে নানাভাবেই প্রভাবিত করে চলেছে তা আর না বললেও চলে। একটি নিবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘প্রকৃতিবিজ্ঞানী’ বলে অভিহিত করেছেন। সেখানে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের অফুরন্ত জীবনীশক্তি ধার করে আমরাও চিরঞ্জীব হতে পারি। রবীন্দ্রনাথের জীবনধারা থেকে শিক্ষার অনেক কিছু আছে। ’

২০০৭ সালে লিখিত একটি নিবন্ধে রবীন্দ্র প্রসঙ্গে বলেন, ‘তাই যদি হয় তাহলে বলতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা বাঙালি জীবনে শুধু নয়, বিশ্বমানব মননে একটি চিরস্থায়ী আবেদন। শেষের কবিতা পড়তে গেলেই রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে উপলব্ধি করতে হয়, নতুন করে তাঁকে প্রথম থেকে চিনে নিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই তিনি চিরনতুন। ’

সম্ভবত বর্তমান বিশ্বে শতবর্ষী নিবেদিতপ্রাণ রবীন্দ্রভক্ত ডা. হিনোহারার মতো আর দ্বিতীয় কেউ নেই, যিনি আমাদেরকে রবীন্দ্র-বিষয়ে একাধারে আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত করতে পারেন।

জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক
probirsrkr06@gmail.com    
    
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।