ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

দেশে দেশে নবান্ন উৎসব

ফিচার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৬, নভেম্বর ১৫, ২০১১
দেশে দেশে নবান্ন উৎসব

ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগেকার কথা। এক ধরনের বীজ (ধান) মাটিতে ছিটিয়ে দিলে কয়েক দিনের মধ্যেই তার থেকে চারাগাছ মাথা তোলে।

গুহার আশপাশে এভাবেই বেড়ে উঠতে থাকে হাজার হাজার গাছ। শুরু হয় কৃষিকাজ আর কৃষিভিত্তিক সভ্যতার। নারীরাই এর আবিষ্কর্তা।

এই কৃষিকাজের কল্যাণেই যাযাবর মানুষের থিতু হওয়া শুরু হলো। মানুষ ঘরবাড়ি বানাতে শুরু করলো। এভাবেই পরিবারের গোড়াপত্তন হলো। যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার বয়স মাত্র দুশো বছর আগে হলেও কৃষির ওপর ভিত্তি করেই ২০ থেকে ৩০ হাজার বছর ধরে জীবনযাপন করে আসছে মানুষ।

ফোকলোর-গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘শিবায়নে পাওয়া যায় শিব একাই কয়েক শ প্রকার ধানের চাষ করতেন। এ অঞ্চলে কয়েক শ প্রকার ধানের কথা জানা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অঞ্চনলক্ষ্মী, অমৃতশালী, আকাশমণি, আঙ্গুরশাল, উত্তমশালী, কপিলভোগ, করমশাল, কাজলা, কাটারিভোগ, বেগমপছন্দ, রাজভোগ, নেত্রমালী, কাশফুল, কার্তিকা, কালিজিরা, কালোমানিক, জনকরাজ, রাজভোগ প্রভৃতি। ’

বাংলার মাটিতে অতি সমৃদ্ধিশালী এরকম শত শত ধানের চাষ হলেও আজ হাইব্রিডের প্রভাবে সেই ঐতিহ্য বিলুপ্তপ্রায়।




বাংলাদেশের অধিকাংশ উৎসবই ঋতুভিত্তিক এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নবান্নও এ ধরনের একটি উৎসব। ‘নবান্ন’ সন্ধিবিচ্ছেদ করলে পাওয়া যায় : নব+ অন্ন= নবান্ন। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধানের ভাত ও বিভিন্ন তরকারিসহ যে খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করা হয়, তা-ই নবান্ন। এটি পুরোপুরি একটি শস্যভিত্তিক লোক-উৎসব। অধিক শস্যপ্রাপ্তির প্রত্যাশা, সন্তানের মঙ্গল, বৃষ্টি কামনা, সমৃদ্ধ ও সুখী জীবনের আকাঙ্ক্ষা—একসময় এসব বাসনা এই উৎসবের মূল কারণ হলেও, ধীরে ধীরে এর পরিধি এত ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছিল যে, এ উৎসবটি মানুষের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিণত হয়।

‘অগ্র’ মানে প্রথমেআর ‘হায়ণ’ মানে মাস অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস। একসময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। নবান্ন কৃষিভিত্তিক উৎসব হলেও এটি একটি ঋতুভিত্তিক উৎসবও। অস্ট্র্রিক জনগোষ্ঠী আমাদের এ অঞ্চলে কৃষিকাজের সূচনা করেছিল। কাজেই এই উৎসবও যে তাদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করেছিল, তাতে তেমন সন্দেহ নেই।

লোক-গবেষক শামসুজ্জামান খান বলেছেন,  ‘নবান্ন উৎসব বা বাংলা নববর্ষের দিনের আমানি উৎসব-এর পেছনে আদিম সংস্কার বা জাদুবিশ্বাসের প্রভাব থাকতে পারে। এমনকি এর সঙ্গে উর্বরতার শক্তিপূজার সম্পর্ক থাকাও অস্বাভাবিক নয়। এই উর্বরতার শক্তিপূজার সঙ্গে অস্ট্রিকদের অধিক শস্যউৎপাদন-বিশ্বাসের সম্পর্ক ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আমানি, নবান্নের মতোই আরেক কৃষি উৎসবের নাম ‘আখের-বাখার’। এটি রাঢ়বাংলার, বিশেষ করে বীরভূম অঞ্চলের অনুষ্ঠান। পয়লা মাঘ সন্ধ্যায় এ উৎসব অনুষ্ঠান হয়। এ অনুষ্ঠানে কোনো দেবতার পুজো নেই। এই অনুষ্ঠানটি একই সঙ্গে জাদুবিশ্বাসমূলক এবং প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের। এর শব্দবন্ধে মুসলিম অনুষঙ্গ লক্ষণীয়। বলা হয়, আখের বাখার অর্থ শস্যভাণ্ডার মাড়াই। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ের একটি চিত্র পাওয়া যায়। ’

তবে নবান্ন উৎসব জাদুবিদ্যামূলক উৎসব নয়, একে বরং কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপনসূচক উৎসব বলা যেতে পারে। এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও নয়। কারণ এতে চন্দ্র-সূর্যের কোনো ক্ষণ বা তিথিলগ্ন নির্দিষ্ট করা নেই। ফরাসি নৃবিজ্ঞানী কার্দ দ্য কুকদ সভ্যতার যে বিকাশের কথা বলেছেন, তাতে নবান্নকে ফসল উৎপাদন এবং ফসলকে খাদ্যরূপে গ্রহণের আনন্দ উৎসব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলার নবান্নে হিন্দুরা ধর্মীয় পবিত্রতায় বাড়িঘর পরিষ্কার করেন এবং নিজেরা শুচিস্নিগ্ধ হয়ে উৎসবে অংশ নেন। পূর্বপুরুষদের আত্মার মঙ্গলার্থে তারা এই দিনে নতুন ফসলের পায়েস, ভাত এবং নানা ব্যঞ্জন নিবেদন করে থাকেন। এটি একটি প্রাচীন আচার ও লোকবিশ্বাস।

অন্যদিকে মুসলমানরা নতুন চালের পায়েস মসজিদ বা মাজারে দিয়ে আসেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই ধানের প্রথম গোছাটি ঘরের প্রবেশমুখে ঝুলিয়ে দেন। প্রায় দেড়শো বছর আগে লাঙলের চারদিকে ধান ছড়িয়ে দিয়ে মানুষ আনন্দ-নৃত্যে মেতে উঠত, এমন বিবরণও পাওয়া যায়। শ্রীদীনেন্দ্রনাথ রায়ের ‘নবান্ন’ প্রবন্ধ থেকে তৎকালীন বাঙালি সমাজের নবান্ন আয়োজনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। তিনি বর্ণনা করেন : ‘অবশেষে নবান্নের আয়োজন আরম্ভ হইল। আচার্য-কর্তিত কলার পেটকোতে তিনি নবান্নের জন্য গৃহে প্রস্তুত আতপ চাউল এক মুষ্টি রাখিয়া, একটা বড় পাত্রে কতকগুলি ফলমূল, আখ, আলু, কলা, মুলো, নারিকেল চাকা চাকা করিয়া কাটিয়া রাখিলেন, এবং একটা বড় পাথরের খোরায় এক খোয়া কাঁচা দুধ একটা খেত্তুরে বাটীতে এক বাটী নূতন খেজুরে গুড় ও বড় পিতলের রেকাবীতে বাতাসা, কাঁচা গোল্লা, গুড়ে মোণ্ডা প্রভৃতি মিষ্টান্ন রাখিয়া দিলেন; ছেলেমেয়েরা অদূরে বসিয়া সদ্যঃস্নাতা সিক্তকেশা শুভ্রবসনা পিসীমার কাণ্ড দেখিতে লাগিল। ...ছেলেরা কলাপাতে অল্পপরিমাণ নবান্ন লইয়া চারিদিকে ছুটিয়া চলিল। কেহ ছাতের উপর কাক শালিক প্রভৃতি পাখীর জন্য তাহা রাখিয়া আসিল; কেহ ঢেঁকির ঘরে গিয়া ইঁদুরের গর্তে খানিক ঢালিয়া দিল; মাছদের নবান্ন খাওয়াইতে একটি ছেলে নদীতে চলিল; একটি ছেলে খানিকটে নবান্ন গরু বাছুরের জন্য গোয়ালঘরে লইয়া গেল; কেহ শৃগালের জন্য চাট্টি চাউল খান দুই শাঁক আলু ও একটুকরা পাকা কলা লইয়া বাঁশবনে কিংবা আশ্যাওড়ার জঙ্গলে ফেলিয়া আসিল। সকল জন্তুর জন্য নবান্ন বিতরিত হইলে, গৃহস্থপরিবারগণ একত্র সমবেত হইয়া, দুধ গুড় ও নানাবিধ ফলমূল মিশ্রিত চাউল খাইতে আরম্ভ করিল। বাড়ির বউ ঝিরা এক এক বাটী চাউল লইয়া রান্নাঘরের বারান্দায়, উননের ধোঁয়ায়, ভিজে চুলে, পা মেলিয়া বসিয়া, সিক্ত তণ্ডলরাশি নতমুখে চর্বণ করিতে লাগিল। রাখাল, কৃষাণ ও পরিবারস্থ অনুগত ব্যক্তিগণ সকলের নবান্ন হইয়া গেল...। ‌‌’

বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের এক বিবরণে ইহুদিদের তিনটি উৎসবের কথা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে দুটি উৎসবই ফসল কাটার (নবান্ন)। একটির নাম ‘পেসাস’, অন্যটির নাম ‘শুক্কত’। এই উৎসবের শুরু খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েক হাজার বছর আগে। ওল্ড টেস্টামেন্ট কেবল একটি ধর্মগ্রন্থই নয়, পৃথিবীর প্রাচীন যুগের ইতিহাসেরও নিদর্শন। তাতে বলা হয়েছে, ৪ থেকে ৫ হাজার বছর আগেও পৃথিবীতে নবান্নের মতো উৎসব পালন করা হয়েছে।

গবেষক খন্দকার মাহমুদ হাসান বৈদিক সভ্যতার প্রাচীনতম গ্রন্থ (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ অব্দে রচিত) ঋগ্বেদ উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন কৃষি ছিল প্রাণসঞ্চারী কাজ এবং নতুন শস্য মানুষকে দিত নতুন জীবন। ঋগ্বেদে কৃষিকাজের সমর্থনে বলা হয়েছে, ‌‌`‌‌‌আমাদের লতাগুল্ম মধুময় হোক, স্বর্গ, জল এবং আকাশের মধ্যাঞ্চল আমাদের জন্যে মধুরিমায় পূর্ণ হোক। ...আমাদের বৃষরা আর মানুষেরা আনন্দিত চিত্তে কাজ করুক, লাঙল আনন্দে সে তার রেখা টেনে যাক...। ইন্দ্র (বৃষ্টির দেবতা হিসেবে) লাঙলের রেখাকে নিচে নামিয়ে আনবেন; সূর্যদেব সঠিক পথে একে পরিচালিত করবেন। ...লাঙলের ফলক আনন্দে কর্ষিত ক্ষেত্রকে উপড়ে ফেলুক, কৃষকেরা বৃষগুলোকে চালনা করুক আনন্দে। ’

দীনেন্দ্রনাথ রায় তাঁর ‘পল্লীবৈচিত্র্য’ বইতে লিখেছেন, ‘বঙ্গের অধিকাংশ পল্লীতেই নবান্ন অগ্রহায়ণ মাসের একটি আনন্দপূর্ণ প্রয়োজনীয় গার্হস্থ্য উৎসব। পল্লীবাসীগণের মধ্যে পিতৃপুরুষ ও দেবগণের উদ্দেশে নতুন চাউল উৎসর্গ না করিয়া স্বয়ং তাহা গ্রহণ করেন না। প্রাচীনগণ মনে করেন, নবান্ন না করিলে যথেষ্ট প্রত্যাবায় আছে। এমন কি অনেক প্রবাসীও এই উপলক্ষে প্রবাস হইতে গৃহে সমবেত হইয়া আত্মীয়স্বজনগণের সহিত মিলিয়া নবান্ন করিতেছেন এই দৃশ্য পূর্বে আমাদের পল্লী অঞ্চলে বিরল ছিল না। ’ এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে, কতটা প্রাণের টানে নবান্ন উৎসব এখন থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে পালন করা হতো।

একসময় অগ্রহায়ণ মাস একসঙ্গে দুই চরিত্র নিয়ে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত ছিলো : ১. ফসল তোলার উৎসব ও ২. নববর্ষের উৎসব। লেখক-গবেষক আহমদ রফিকের মতে, অগ্রহায়ণকে ‘বছর শুরুর মাসের মর্যাদা ছেড়ে দিতে হল মুঘল সম্রাটের হিসাব-নিকাশের কারণে। জয়ের টিপ পরানো হলো রুদ্র বৈশাখের কপালে। সম্রাটের খাজনা আদায়ের হিসাবে পাল্লা ভারী হোক বা না হোক আবহাওয়া ও পরিবেশ বিচারে বৈশাখ কিন্তু এ দেশে উৎসব-অনুষ্ঠানের উপযোগী মাস নয়। কড়া রোদ, গুমোট গরম, মাঝেমধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব নিয়ে সময়টা মোটেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অনুকূল নয়, উপভোগ্য তো নয়ই। তুলনায় অগ্রহায়ণে শীতের আমেজমাখা রোদ, আকাশে গাঢ় নীলের বিস্তার, অনার্দ্র বাতাসের নরম ছোঁয়া সব কিছুই যেন নববর্ষ অনুষ্ঠানের অনুকূল। সব দিক বিচারে অগ্রহায়ণকে বছর শুরুর মাস হিসেবে ফিরিয়ে এনে পূর্ব-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই বোধ হয় যুক্তিসংগত। নববর্ষ ও নবান্ন তখন আগের মত উৎসবে আনন্দে একাকার হয়ে যেতে পারে। ’ এ কথা সত্য যে, বৈশাখ মাস থেকে বছর গণনার চিন্তাধারা এসেছিল শুধু খাজনা আদায়ের ওপর ভিত্তি করে, যেমনটি এখন সর্বত্রই আর্থিক বৎসর হিসেবে জুলাই থেকে জুন হিসাব করা হয়।

বৌদ্ধরা তাদের ভিক্ষুদের সংবৎসরের ‘চীবর দান’ করেন। বাংলাদেশের সাঁওতাল, গারো (মান্দি) আদিবাসীরা সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব পালন করেন। সাঁওতালরা বলেন, ‘সোহরায় উৎসব’। তারা সাতদিন সাতরাত ধরে এই উৎসব পালন করেন। মান্দিরা বলেন ‘ওয়ানগাল্লা’। ম্রো আদিবাসীরা ‘চামোইনাত’ উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে আপ্যায়ন করেন।

চীনেও নবান্ন উৎসব পালিত হয়। তাদের ফসলের প্রধান উৎসব ‘চুং চু’ই’। এটি অাগস্ট মুন ফেস্টিভাল নামেও পরিচিত। উৎসবটি সাধারণত বছরের অষ্টম মাসের ১৫ তারিখে পালিত হয়। এতে গ্রান্ডমা, আপেল ও পাই দিয়ে কেক তৈরি করে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। তবে কেকটি অবশ্যই পূর্ণচাঁদের মতো গোলাকার এবং হলদে রঙের হতে হয়। প্রত্যেক কেকের ওপর থাকে খরগোশের ছবি। কারণ খরগোশকে চীনারা চাঁদের প্রতিচ্ছবি মনে করে। শীতল সময়ে একটি পূর্ণ চাঁদনী রাতে তারা উৎসবটি পালন করে এবং এই রাতকে তারা সৌভাগ্য এবং ভালবাসার রাত মনে করে। পরিবারের সবাই মিলে একসংগে নতুন ফসলের তৈরি খাবার গ্রহণ করে এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠায়।

ব্রিটেনে নবান্ন উৎসব পালিত হয় গান, চার্চ সাজানো, আনন্দ এবং প্রার্থনার মধ্য দিয়েয়। এ সময় চার্চকে সাজানো হয় ফল ও খাদ্যের ঝুড়ি দিয়ে। এই উৎসবকে তারা ফসলের উৎসব বা ফসল ধন্যবাদ উৎসব বলে থাকে। ব্রিটিশরাও চীনাদের মতো একটি পূর্ণচন্দ্রের রাত্রি বেছে নেয়। তবে তারা সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ বা কাছাকাছি কোনো তারিখের পূর্ণচন্দ্রের রাতে উৎসবটি পালন করে। তবে কেবল চার্চ বা প্রার্থনালয়েই নয়, এটি বাড়িতে, এমনকি স্কুলেও আয়োজন করা হয়।

ইহুদিরা একে সবচে বড় বাৎসরিক উৎসব ‌‌‌‌’সুক্কত’ বলে উদ্যাপন করে। এটি তিন হাজার বছরের প্রাচীন একটি উৎসব।

তিব্বতে অত্যন্ত জাকজমকের সংগে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। এতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়ে তাদের ফসলের ওপর ও পাশ দিয়ে হেঁটে যান।

নেপালে পাঁচটি বড় উৎসব আছে, যে দিনগুলোতে সরকারি ছুটি থাকে। এর মধ্যে নবান্ন একটি। একে বলা হয় ‘কইয়াগরাত পূর্ণিমা’। পাহাড়ে অসংখ্য কৃষকের জন্য এই উৎসবটি একই সংগে খুব আনন্দের এবং প্রার্থনার। এখানেও চাঁদনী রাতে উৎসব আয়োজন করা হলেও দিনেও চলতে থাকে।

গ্রিকদের নবান্ন উৎসবের নাম ‘থেসমসফোরিয়া’। এটি তারা পালন করে বাঙালির মতোই, শীতের সময়ে। গ্রিক নারীরা উৎসবের প্রথম দিন শস্যের কঞ্চি দিয়ে ঘরের চাল ছেয়ে নেয়, দ্বিতীয় দিন তারা সবকিছু গোছায় এবং তৃতীয় দিন শস্য, ফল এবং নানা ধরনের উপকরণ দিয়ে পিঠা এবং উপহারসামগ্রী তৈরি করে।


লক্ষণীয় যে, বিশ্বের অধিকাংশ নবান্ন উৎসব প্রায় সর্বত্রই শীতের আগমনী সময়ে বা হেমন্তে উদযাপিত হয়।
রোমানদের নবান্ন উৎসবের নাম ‘সেরেলিয়া’। রোমানরা তাদের দেবতা সেরেসের প্রতি সম্মান বা ধন্যবাদ জানিয়ে এই উৎসব পালন করেন। তারা প্রতি বছর অক্টোবরের ৪ তারিখ নবান্ন পালন করে। গান, খেলাধুলা এবং প্যারেড তাদের উৎসবের অঙ্গ।

প্রাচীন মিশর তার ফসল ও উর্বরতার দেবতা মিন’র সম্মানে নবান্ন উৎসব করত। মিশরীয়দের বিশ্বাস, তাদের ফসল বা শস্য তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে, সেজন্য তারা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নবান্ন উৎসব করে।

আমেরিকায় ১৬২১ সালে প্রথম অভিযাত্রীদল প্রচুর পরিমাণ ফসল উৎপাদন করে। এর মধ্যে ছিল গম, সবজি, ফল। এমনকি প্রচুর মাছও। আর এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় এত বেশি ছিল যে, পরের মৌসুমের জন্যও তাদের ভাবনা ছিল না। সে বছর থেকেই তাদের গভর্নর উইলিয়াম ব্রাডফোর্ড সবাইকে নিয়ে নবান্ন উৎসব শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ১৭৭০ সালে জাতীয় কংগ্রেস রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি পালন করে। ১৮১৭ সালে নিউ ইয়র্ক রাজ্য একে বাৎসরিক প্রথা হিসেবে গ্রহণ করে এরপর থেকে অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোও উদ্যাপন করতে শুরু করে। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এই উৎসবের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করেন। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার নবান্নর জন্য সরকারি ছুটি থাকে।

কানাডা আমেরিকার আদলে নবান্ন উৎসব বা ফসলের উৎসব পালন করে ১৮৭৯ সাল থেকে। অক্টোবরের দ্বিতীয় সোমবার নবান্ন উৎসব করে তারা।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন নামে বা ধরনে নবান্ন পালিত হয়।

রাশিয়ায় নবান্নকে বলা হয় রদুনিৎসা। এছাড়া ইরান, জাপান, এমনকি ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ও ধরনে নবান্ন উদযাপন করা হয় ।

সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যসমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক আর মাটির সাথে বন্ধনযুক্ত উৎসব হিসেবে নবান্ন বরং তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশেই অবহেলিত। পৃথিবীর অনেক দেশে যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে, সরকারি ছুটিসহ উৎসবটি পালিত হয়, সেখানে বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব আয়োজনের জন্য পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে চারুকলার বকুলতলা বরাদ্দ পেতেও ঘাম জড়াতে হয়।

বাংলাপিডিয়া লিখেছে ‘বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব পালন করত (?) প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়’। এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং নবান্ন সভ্যতার শুরু থেকে আসা সব সম্প্রদায়ের মানুষের উৎসব।

উৎস : ব্লগ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।