ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

আমঝুপি নীলকুঠি

এখানে হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা হরণের নীলনকশা

জুলফিকার আলী কানন, মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:০৪, নভেম্বর ১৫, ২০১১
এখানে হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা হরণের নীলনকশা

ফরাসি যুবক লুই বান্নো, ক্যারেল ব্লুম, জেমস হিল, নীল কুঠিয়াল মিকেনি সিম্পসন, ফারগুসেন এখন এ উপমহাদেশের একটি ইতিহাস। একখণ্ড সকরুণ স্মৃতি।

এদের প্রতাপ আর অত্যাচারে জর্জরিত ছিল এ অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ।

নীলকরদের বিচিত্র ধরনের অত্যাচারের চিত্র সব জায়গায় একই ছিল। কিংবদন্তির মতো শোনা যায়, অবাধ্য চাষীর মাথার ওপর মাটি দিয়ে নীলের বীজ বপন করে গাছ বের না হওয়া পর্যন্ত নাকি দাঁড় করিয়ে রাখা হতো! আমঝুপি ও ভাটপাড়া নীলকুঠিতে এখনো নীল গাছ দেখা যায়। এ আগাছা নীলগাছ এখনও অতীতের নীলকরদের সেই ভয়াল অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নীলগাছ থেকে তৈরি রং নীল হলেও আসলে সেটি ছিল বাংলার চাষীদের বুকের পুঞ্জিভূত রক্তের জমাটবাঁধা কণিকা।

নীল চাষকে নির্ভর করে এ দেশে নীল শিল্পের প্রবর্তন হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে। প্রথম এ দেশে নীল চাষের সূচনা করেন লুই বোনাদ নামের একজন ফরাসি বণিক। জানা যায়, ১৭৮৮ সালের ১ নভেম্বর লন্ডনের কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে লর্ড কর্নওয়ালিস জানান যে, বাংলাদেশের নীল ইউরোপের বড় একটি অংশের চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ হবে। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশকে নীল চাষের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে গণ্য করে।

তৎকালীন বাংলাদেশের নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া, মেদেনীপুর, বীরভূম, যশোর, হাওড়া, পাবনা, ফরিদপুর ও হুগলী জেলায় নীল চাষ প্রবর্তন করা হয়। ১৭৯৫ সালে যশোরে রুপদিয়া বন্ড নামের একজন নীলকর কারখানা স্থাপন করেন। এ সময় যশোরে ১০৩ বর্গমাইল জমি নীল চাষের আওতায় নেওয়া হয়। ওই সময় এ অঞ্চলে প্রায় ৫০০ নীলকুঠি স্থাপন করা হয়। আর নীলচাষ হতো প্রায় ২০ লাখ ৪০ হাজার একর জমিতে। নীল উৎপাদন হতো ১২ লাখ ৮০ হাজার মণ। এর মধ্যে শুধু নদীয়া জেলায় নীলচাষ হতো ১৭০০ বিঘা জমিতে। সেখানে উৎপন্ন হতো প্রায় ৭ মণ নীল।

ইংরেজ আমলে গড়ে ওঠা সেই নীল কুঠিগুলো আজ ধংসের দারপ্রান্তে। ইউরোপীয়দের দ্বারা বাংলায় নীল চাষের প্রর্বতন হয় এবং একশ বছর পর উনিশ শতকের শেষে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। নীলকরদের জন্য এ ব্যবসা লাভজনক হলেও চাষীদের জন্য ছিল ভয়াবহ অভিশাপ। এ কারণে নীলচাষের প্রতি চাষীদের ছিল অনীহা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীল চাষ করানোর ফলেই ১৮৫৮ সালে নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়। ক্রমে বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। ১৮৯৫ সালে নীল চাষের অবনতি ঘটে। এই নীল ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই একসময় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য নীলকুঠি। নীলচাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নীলকুঠিগুলো পরিণত হয় পোড়ো বাড়িতে।

নীল বিদ্রোহের সময় নীলকুঠি ভবনগুলো ছিল নীলচাষীদের লক্ষ্যবস্তু। তাদের শোষণ-নির্যাতনের প্রতীক এই কুঠিগুলোতে তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। নীলচাষীদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আজ পর্যন্ত টিকে আছে মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি। মেহেরপুর ব্রিটিশ শাসন-আমলে অবিভক্ত নদীয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৮৯৬ সালের দিকে তৎকালীন নদীয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমায় নীল চাষ শুরু হয় বলে অনুমান করা হয়।

আমঝুপি নীলকুঠিটি মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত। আমঝুপি গ্রামের দক্ষিণপাড়ার কাজলা নদীর পাড়ে এক চিত্তাকার্ষক নৈসর্গিক পরিবেশে এ নীলকুঠির অবস্থান। অতীতে এটি নীলকুঠি হিসেবে নির্মিত হলেও পরে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাচারি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই কুঠিবাড়ি ছিল নীলকরদের নির্যাতন কেন্দ্র। বর্তমানে আমঝুপি নীলকুঠিটি পর্যটন কেন্দ্রের আওতায় একটি সরকারি রেস্ট হাউস হিসেবে নিবন্ধিকৃত। কুঠিবাড়িটি মেহেরপুর জেলা পরিষদের কর্তৃত্বাধীন। জেলা পরিষদ ও রাজস্ব বিভাগ উভয়ই এর ওপর কর্তৃত্ব দাবি করায় তাদের অর্ন্তদ্বন্দ্বর কারণে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বাধগ্রস্ত। এসব কারণে এখানে আগত ভ্রমণকারী ও পর্যটকদের পড়তে হয় বিব্রতকর অবস্থায়।

এ ভবনে ছয়টি কক্ষ বিশেষ অতিথিদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত আছে বটে, কিন্তু কক্ষগুলো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। একটি কক্ষের ছাদ ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

মোট সাত একর জমির ওপর আমঝুপি নীলকুঠিটি স্থাপিত। কুঠিবাড়ি ঢোকার প্রবেশ পথের দু পাশের রাস্তার বড় বড় আম গাছগুলো ঝড়ে ভেঙ্গে গেছে। তারপরও কুঠিবাড়ির চারদিকে আমগাছে পরিপূর্ণ। আমঝুপি গ্রামের নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও ধারণা করা হয় এ অঞ্চলে আমগাছের সমারোহ এবং ঝোপঝাড়ের আধিক্য থাকায় নাম হয়েছে আমঝুপি।
কুঠিবাড়ির মূল ভবনটি সূদৃশ্য একতলা ভবন। এর অভ্যন্তরে রয়েছে মোট পনেরটি কক্ষ। স্তম্ভসারির ওপরে লাল টালির ছাদ-আচ্ছাদিত বারান্দা। তিনটি করে স্তম্ভ একত্রে স্থাপিত, যার ওপর সৃষ্ট ঢালু ছাদের বারান্দা আকর্ষণীয় রুপ লাভ করেছে। বারান্দা পার হয়ে প্রবেশ করতে হয় কুঠির অভ্যন্তরীণ কক্ষে। ছোট-বড় কক্ষগুলির মধ্যে একটি কক্ষের মেঝে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মিত। আমঝুপি গ্রামে সাপের প্রাদুর্ভাব ছিল বলে জানা গেছে। কুঠিবাড়ি নির্মাণের সময় সাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কক্ষটির মেঝে মার্বেল পাথর দিয়ে অত্যন্ত মসৃণ এবং ঢালু যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছিল। এমন ঢালু মেঝে তৈরি করার নেপথ্যে যেন সাপ প্রবেশ করতে না পারে সে কথাটি মনে রাখা হয়েছিল। এ ভবনে রয়েছে তিনটি শয়ন কক্ষ। পেছন দিকে রয়েছে ভোজনকক্ষ। একটি কক্ষের মাঝে দেওয়ালের ডানদিকে কক্ষ উষ্ণ রাখার জন্য রয়েছে ফায়ারপ্লেস। তাছাড়া কক্ষগুলোর উপরিভাগে রয়েছে রঙিন কাচে আবৃত গোলাকার ক্ষুদ্র আলো প্রবেশের জানালা।

এই নীলকুঠিতে আছে আরো কয়েকটি ছোট-বড় কক্ষ। এসব কক্ষ ব্যবহৃত হতো বৈঠকখানা, সংগীত, নৃত্যগীত এবং আমোদ-প্রমোদ করার জন্য। এর সাথে রয়েছে চারটি সাজঘর ও পরিচারকদের কোয়ার্টার। পশ্চিম দিকে অবস্থিত পরিচারকদের ও সাহায্যকারীদের বসবাসের দালান যা বর্তমানে কুঠিবাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ও তত্বাবধায়কের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অপ্রধান ভগ্নপ্রায় ভবনটি ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে সংস্কারবিহিন দাঁড়িয়ে আছে। মূল ভবন না হওয়ায় এগুলো সংস্কার করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে আস্তাবলের ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে এ ভবনের অংশবিশেষ ব্যবহার করা হচ্ছে ইউনিয়ন তহসিলের অফিসের কাজে। উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত নিশ্চিহ্নপ্রায় ভবনটি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পশ্চিমে রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির অপেক্ষাকৃত মজবুত একটি ভবন, যা একসময় গোপন শলা-পরামর্শ করার বৈঠকখানা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

জনশ্রুতি আছে, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে পলাশী যুদ্ধের প্রথম বৈঠক এই গোপন কক্ষটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানেই লর্ড ক্লাইভ, ঘসেটি বেগম, মীর জাফরসহ অন্য ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের নীল নকশা তৈরী করেছিল। কাজলা নদীর ওপর পর্যন্ত সম্প্রসারিত সেতু, শানবাধানো বসার আসনবেষ্টিত ঘাট নিঃসন্দেহে এই কুঠির সবচে চিত্তাকর্ষক ও ব্যাতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। কুঠিভবনটির দৈর্ঘ ১৫ মিটার, প্রস্থ ১০ মিটার ও উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার। এতে রয়েছে দুটি প্রবেশ পথ ও ১৮টি জানালা। আমঝুপি কুঠিবাড়ির পূর্বদিকে রয়েছে একটি মনোরম ফুলের বাগান। এছাড়া তহসিল অফিসের সামনে রয়েছে একটি পেয়ারা বাগান। কুঠিবাড়ির আম্রকাননের পাশাপাশি রয়েছে ইংরেজ আমলে লাগানো বেশ কিছু নাম না জানা বিশাল আকৃতির গাছ। দক্ষিণ দিকে কাজলা নদীর কোল ঘেঁষে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে নারিকেল গাছ। এসব গাছ ও বাগানের মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশ কুঠিবাড়ির স্থাপত্যে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা, যা আমঝুপি নীলকুঠির নিথর পরিবেশকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত।

maharpurনীল তৈরি করতে প্রয়োজন হতো পানির। সেজন্য বাংলাদেশের নীলকুঠিগুলো গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো নদীর ধারে। আমঝুপি নীলকুঠিটিও তাই তৈরি হয়েছিল কাজলা নদীর তীরে।

আমঝুপি নীলকুঠিতে দেশীয় স্থাপত্যের সাথে ইউরোপীয় স্থাপত্য বিশেষ করে ব্রিটিশ স্থাপত্যেরীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। মূল কুঠি ভবনের বহির্বিভাগ দেখে এর সামগ্রিকক অবস্থা অনুধাবন সম্ভব নয়। ভবনটির বাইরে চাকচিক্য না থাকলেও বিবর্ণরুপ পরিগ্রহ করেনি। অভ্যন্তর ভাগের অবস্থা রহস্যাবৃত। সাধারণ জনগণের ধারণা, এ ভবনটির ভেতরের তলায় রয়েছে আরো একটি ভূর্গভস্থ কক্ষ, যা গোপন অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ কক্ষটির মেঝেতে রয়েছে একটি কূপ, যার ব্যবহার রহস্যাবৃত।

জনশ্রুতি আছে, নীলচাষে অবাধ্য চাষীদের এখানে নির্যাতন করে হত্যা করে এ কূপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হতো। কুঠিবাড়িটি ১৮১৫-২০ সালের মধ্যে স্থাপিত হয় বলে জানা গেছে। কুঠিবাড়িটি নির্মাণের পর এ পর্যন্ত চারবার সংস্কারকাজ হয়েছে। কুঠিবাড়িটিতে ১৯৬২ সালে প্রথমবার, ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয়বার, ১৯৯৬ সালে তৃতীয়বার ও ১৯৯৯ সালে চতুর্থবার সংস্কারকাজ হয়েছে।

আমঝুপি নীলকুঠিটি সংস্কার করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুললে সরকার এখান থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় করবে বলে মত প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।