ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বহুমাত্রিক সংকটে বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট

আশরাফুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০২, নভেম্বর ১৭, ২০১১
বহুমাত্রিক সংকটে বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট

[সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য এবং পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুতে সুন্দরবন রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। তবে যাকে নিয়ে এত কিছু সেই সুন্দরবনের কী অবস্থা এই মুহূর্তে? সম্প্রতি সুন্দরবন এলাকা ঘুরে এসে ধারাবাহিকভাবে জানাচ্ছেন আমাদের অতিথি প্রতিবেদক ও পরিবেশকর্মী আশরাফুল ইসলাম।

]  

বহুমাত্রিক সংকটে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। বাংলাদেশের প্রধান সমৃদ্ধ ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দেওয়া নিয়ে যখন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানামুখী তৎপরতা চলেছে, তখনও এসব সংকট মোকাবিলায় সামান্যই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জলজ ও বনজ সম্পদে ভরপুর প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বিশালায়তন এই বনের বর্তমান মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়। এর জন্য সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার তুঙ্গে থাকা জলবায়ু পরিবর্তন না মানবসৃষ্ট অন্য সব কারণ দায়ী তা নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে বিভিন্ন মহলে।

বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানালেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এখনো না বাড়লেও বর্তমানে লবণাক্ততা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এর প্রভাবে সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী মরতে শুরু করেছে ব্যাপকহারে। বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় চার যুগ আগে সুন্দরী বৃক্ষের মড়ক সীমিত পরিসরে দেখা দিলেও বর্তমান সময়ে এসে তা অনেক বেড়ে গেছে। ২০৫০ সালের পর সুন্দরবনে সুন্দরী গাছের অস্তিত্ব থাকা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছেন খোদ বন কর্মকর্তারা। এছাড়া লবণ-সহিষ্ণু নয় এমন অন্যান্য গাছও মরতে শুরু করেছে।  

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কোবাদক ফরেস্ট অফিসের এক বনকর্মী জানান, যেখানে লবণ বেশি সেখানে বনের গাছের বৃদ্ধি কম আর যেখানে লবণ কম সেখানে বৃদ্ধি বেশি। ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর থেকে সুন্দরবনের উজান থেকে আসা মিঠা পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। ফলে সুন্দরবনে জালের মতো বিস্তার করে থাকা নদীগুলোতে লবণ ও মিঠা পানির সংমিশ্রণে থাকা মাছের সংখ্যাও কমেছে। মাছের প্রাপ্যতা কমায় সুন্দরবনের নদী-নালা-খালগুলোতে মাছ ধরে জীবিকার সংস্থান করা বিপুল সংখ্যক জেলের জীবনও অনিশ্চয়তার মাঝে পড়েছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদগুলোকে সমুদ্রের ভয়াবহ সব দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য সুন্দরবন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এলেও নানা বিপর্যয়ে ক্রমশ সে শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সুন্দরবন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় বনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই আবার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে সুন্দরবন।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: প্রকৃতির অপার বিস্ময় ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের আধার সুন্দরবন ইতিহাস জানার আগ্রহ কমবেশি সবারই রয়েছে। একাধিক স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত সুন্দরবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীরও আগে গঙ্গার মূল প্রবাহ থেকে ভৈরব ও পদ্মা প্রবাহিত হওয়ার পর বর্তমান সুন্দরবন অঞ্চলে ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞদের মতে, পঞ্চম শতক থেকে তের শতকের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠে পলিময় এ দ্বীপ। পরে এটি প্রাকৃতিকভাবেই বিশালায়তনের গভীর বনে পরিণত হয়।

ইতিহাসবিদ ও সাতক্ষীরার কলোরোয়ার শেখ আমানুল্লাহ ডিগ্রি কলেজের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আবুল হোসেনের মতে, ‘প্রাচীনকালে সমৃদ্ধ জনপদ সুন্দরবন স্থান হিসেবে যতই প্রাচীন হোক, এর বর্তমান নামটি তত প্রাচীন নয়। এই অঞ্চলের পরিচিতি প্রচ্ছন্ন রয়েছে ইতিহাসে বর্ণিত গঙ্গারিডি, গাঙ্গেয়, সমতট, কালিকাবন প্রভৃতি স্থান নামের অন্তরালে। মধ্যযুগের মুসলমান ঐতিহাসিকরা এই নিম্নভূমি অঞ্চলকে ‘ভাটি’ নামে উল্লেখ করেছেন। পাঠান যুগের শেষে এখানে বার ভুঁইয়াদের আধিপত্য অতিশয় বৃদ্ধি পেলে এর নাম দাঁড়ায় ‘বারভাটি বাঙলা’। পরবর্তী কালে ‘সুন্দরবন’ এই সুখশ্রাব্য নামটি প্রচলিত হয়। ’

অনেক ঐতিহাসিকের মতো আবুল হোসেনেরও মত, সুন্দরবনের সর্বত্র সুন্দরী বৃক্ষ জন্মে, তাই এর নামকরণ সুন্দরবন হয়েছে এ অনুমান যথেষ্ট যুক্তিসিদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য। ইংরেজ আমলে বিদেশী পর্যটকেরা একে Ôjungle of sundory trees’ বলে আখ্যায়িত করেন। কেউ কেউ সমুদ্রের তীরে অবস্থান হওয়ায় সমুদ্র বন ও এর অপভ্রংশ থেকে সুন্দরবন হয়েছে বলেও দাবি করেন। আবার কেউ চন্দ্রবন বন থেকে চন্দরবন, পরে স্যান্ডারবন বা সুন্দরবন হয়েছে বলে মনে করেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।