ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

দেবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি

ফেরদৌস আহমেদ, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৩৬, নভেম্বর ২৮, ২০১১
দেবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি

মৌলভীবাজার: কোথাও পাহাড়ি পথ, কোথাও আঁকাবাঁকা সমতল। আবার কোথাও উঁচু-নিচু পথ।

সব পথের ধুলোয় লুটিয়ে থাকে পাহাড়ি লাল মাটি ও ঝকঝকে বালি। যেতে যেতে সবুজ প্রকৃতির মাঝে দেখা মেলে চা বাগানের। সারি সারি চা গাছের উপর ছায়াবৃক্ষগুলো শুকিয়ে অস্তিত্ব হারানোর কথা জানান দেয়।

এমনই দৃশ্যপটে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাস করে খাসিয়া জনগোষ্ঠী ও চা শ্রমিকরা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়ার জলের উপর গাছের গোড়া ফেলে খাসিয়া রমণীরা মেতে ওঠে জলকেলি উচ্ছলতায়।   রোদের খেলা আর টলমলে জলে স্নান করে ওরা যেন ফিরে পায় নতুন শুচিতা।

পাহাড়ের ঢালু পথের ধারে কিংবা পাটাতনে বিভিন্ন প্রকার গাছকে জড়িয়ে ধরে ঝুলে থাকে পান পাতা। এই পানের নাম ‘খাসিয়া পান’। অন্যান্য পানের চেয়ে এগুলো একটু উদলা (পুরু) থাকায় সাবধানে চিবোতে হয়। নইলে পানের ঝাঁজে মুখ পুড়ে যাওয়ার অনুভব হয়।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর থেকে তের কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী এলাকা ‘দেবলছড়া পুঞ্জি’। পুঞ্জিতে ৪০টি খাসিয়া পরিবারের বসবাস। এ পুঞ্জির সীমানা পেরোলেই দেখা মেলে ভারত রাজ্যের।

শমসেরনগর থেকে মোটরসাইকেল, মিশুক, সিএনজি অটোরিক্সা, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস কিংবা বাস নিয়ে দেবলছড়া পুঞ্জিতে যাওয়া যায়। পাকা রাস্তা থেকে পুঞ্জির দিকে রওয়ানা দিলেই প্রথমে চোখে পড়বে ক্যামেলিয়া হাসপাতাল। রাস্তার দু’পাশে সবুজ সারি সারি চা বাগান। মিনিট দুয়েক এগোলেই পাহাড়ের খাদে চোখে পড়বে ক্যামেলিয়া লেক। এই লেকের পাশে একটি বড় গলফ মাঠ রয়েছে।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গলফ মাঠ। কিছু দূরেই পুরনো বটগাছ আর বাগানের নিরাপত্তা গেইট। ক্যামেলিয়া লেক পেরোলেই পাহাড়ের পাদদেশে দেখা পাবেন শতবছরের প্রাচীন বটগাছ। এখানে একটি সুদৃশ্য পুরনো মন্দির রয়েছে। স্থানীয় আদিবাসী ও চা শ্রমিকরা মন্দিরে পুজো দেয়, ধর্মীয় আচার পালন করে। বাস নিয়ে গেলে বটের ডাল গাড়িটিকে রাস্তায় আটকে ফেলবে। তাই মাইক্রোবাস কিংবা সিএনজি নিয়েই এপথে যাত্রা শুভ।
DeboChara
বটগাছসমেত মন্দিরটি পেরোলেই পাহাড়ের উঁচু-নিচু মাটির পথ ধরে দু’পাশের চা গাছ মাড়িয়ে বাহনটি চলতে থাকে। টিলার উপর গাড়ি উঠলে চতুর্দিকের ঢালু জমি নজরে পড়ে। তখন সবুজের মাঠে মন হারিয়ে যায়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ ধরে এগোতে থাকলে একসময় পেয়ে যাবেন নো-ম্যান্স ল্যান্ডের সাইনবোর্ড। আরো একটু দুরেই পাওয়া যাবে দেবলছড়া বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) ক্যাম্প।

তারও খানিক দুরে দেবলছড়া পুঞ্জি। শমসেরনগর থেকে দেবলছড়া পুঞ্জি পর্যন্ত পাহাড়ের উপর কড়ই, বনাক, সেগুন, মেহগনি, রাবার গাছ দেখতে পাবেন। এসব গাছের ঝোঁপের আড়ালে পাহাড়ি নানা রঙের বুনো ফুলের হাতছানি এক অনির্বচনীয় আনন্দ নিয়ে আসে। পুঞ্জির পাশে পৌঁছুলেই রাস্তার দু’পাশে শিশু ও যুবকদের অপলক তাকিয়ে থাকাটি আপনার চোখে এসে ধরা পড়বে। বাঙালি ও আদিবাসীর শরীরের গড়নের পার্থক্যটা তখন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পাহাড়ের পাদদেশে (আটতলা সমান) দেবলছড়া পুঞ্জির খাসিয়া মন্ত্রীর বাংলো। নিচ থেকে বাংলোতে উঠতে কয়েক ধাপে পাকা সিঁড়ি ভাংতে হবে। হার্টের রোগীদের সাবধানে উঠাই উত্তম। উপরে উঠেই বাংলোর দেখা পাবেন। পাহাড়ি গাছের গোড়ার অবশিষ্ট ভগ্নাংশ দিয়ে বাংলোর চতুর্দিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বাংলোর পেছনের পশ্চিমদিকে হরিণের ঘর। এই ঘরটিতে কয়েকটি হরিণ শাবকের চকিত চলাফেরায় মুগ্ধ হবেন। এখানে আপ্যায়নের জন্য অনেককেই এগিয়ে আসতে দেখা যাবে।

খাসিয়া মন্ত্রীর বাংলোর পশ্চিম-উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দেখা যাবে পাহাড়ের উঁচু ঢালু জমি সযতনে কেটে তার উপর খাসিয়ারা বসবাসের জন্য বাংলো বানিয়েছে। একটি বাংলোর পর সামান্য ব্যবধান রেখেই অন্য বাংলো। খাসিয়ারা এসব বাংলোয় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বসবাস করছে বছরের পর বছর। মন্ত্রীর বাংলোর পাশেই একটি প্রার্থনা কেন্দ্র ও প্রাইমারি স্কুল। খাসিয়া সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে থাকে।

মন্ত্রীর বাংলোর ঠিক সামনেই একটি কবরস্থান রয়েছে। খাসিয়াদের বংশ পরম্পরায় এখানে সমাহিত করা হয়েছে। কবরস্থানের পাশেই একটি বিশাল মাঠ। এই মাঠে খাসিয়া সম্প্রদায়ের সন্তানরা খেলাধুলা করে। পর্যটকরাও এখানে বিরতি নিয়ে বনভোজনসহ খেলাধুলা করে থাকেন।  

প্রায় প্রতিটি বাংলোর ভেতর ও বারান্দায় খাসিয়া রমণীরা খাসিয়া পান বেছে বেছে ভাগ করে আঁটি বানিয়ে সাজিয়ে রাখছে। সপ্তাহে ৪দিন খাসিয়ারা বরজের গাছ থেকে পান তুলে আনে। একটি আঁটি তারা ৪০-৪৫ টাকা হিসেবে এক কুড়ি (২০ আঁটি) ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকে। বর্ষা মওসুমে পানের ফলন বেশি হওয়ায় বাজারে দাম কম থাকে। এসময় বৃষ্টিতে পঁচে অনেক পান নষ্টও হয়।

খাসিয়াদের সাথে আলাপকালে তারা বাংলানিউজকে জানায়, তাদের একমাত্র ব্যবসা হলো পানকে ঘিরে। পান চাষের উপরই তাদের সারা বছরের জীবিকা নির্ভর করে। সপ্তাহে ৪দিন পান বিক্রি করে তারা পরিবারের খরচ চালিয়ে থাকে। খাসিয়া রমণীরা এবং পুরুষেরা কুয়োর জল দিয়ে বাসনমাজা, খাওয়া ইত্যাদির কাজ করে থাকে। এছাড়া প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পাহাড়ির ছড়ার জল দিয়ে স্নান করা, কাপড় ধোয়া ইত্যাদির কাজ করে থাকে।    

শমসেরনগর থেকে দেবলছড়া পুঞ্জিতে যেতে যে প্রাকৃতিক উপাদান দেখা যায়। তাতে এই এলাকাটি পর্যটনের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত। কিন্তু তের কিলোমিটার রাস্তার যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এই এলাকাকে পর্যটনের উপযোগী করে গড়ে তোলা গেলে আরও উন্নত হবে।

এখানে চা বাগানের জমি লিজ নিয়ে অনেকেই অন্য ফসল চাষ করে থাকেন। এসব জমিতে অন্য ফসল চাষ না করে মোটেলসহ, পর্যটনের উপযোগী করে গড়ে তুললে ব্যক্তিগতভাবে যেমন লাভবান হওয়া সম্ভব, তেমনি সরকারও প্রচুর রাজস্ব পেতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।