যিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, দার্শনিক ও মানবতাবাদী মহাপুরুষ। ফলে সাধারণ লাল দালানের বাড়িটি হয়ে উঠেছে অসাধারণ তীর্থস্থান।
নগ্ন পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে শুরুতেই পাবেন কবিগুরুর খাবার ঘর। খাবার টেবিলের ধরনটাও সংগীত কক্ষের মতো করে সাজানো। এরপর শয়ন কক্ষ। এই ঘরটিতে কবি শুয়ে কাটাতেন জীবনের শেষ সময়টা। ঠিক এর পাশের একটি কক্ষে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৪১-এর ৩০ জুলাই এ বাড়িতেই কবি তার শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’-এর ডিক্টেশন দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাতদিন পর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। ঘরটি থেকে বের হলে যে ছবিটি আপনাকে আবেগাপ্লুত করবে, সেটি কবির মহাপ্রয়াণে শোকযাত্রার ছবি। কলকাতার সকল সড়ক, মহাসড়ক, অলিগলির পথ যেন মিশেছিল শোকযাত্রায়। সেদিনের মানুষের এমনই তীব্র স্রোত ছিল যে, কবির সন্তান ঠিক সময়ে শ্মশানে পৌঁছাতেই পারেননি। পরে জলেপথে শ্মশানে পৌঁছে সে কাজটি করেন কবির আরেক স্বজন। সেসব ছবি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গল্প শোনাবে আপনাকে। উপরের ঘরগুলোতে রয়েছে তার ব্যবহৃত পোশাক, আরাম কেদারা, বইপত্র, বিলেত থেকে আনা নানা জিনিসপত্র। রয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের ছবি এবং নানা জানা-অজানা তথ্য। বিভিন্ন নাটকে যেসব পোষাক পরে তিনি অভিনয় করতেন, তাও রয়েছে সেখানে।
একটি ঘরে রয়েছে রবি ঠাকুরকে নিজ হাতে লেখা মৃণালিনী দেবীর চিঠি, তার ওপর মৃণালিনী দেবীর একটি বড় ছবি টানানো। এই ঘরেই মৃণালিনী দেবীর শেষশয্যা পাতা হয়েছিল। এ ঘরটির ঠিক পেছনে রয়েছে খুব সাদামাটা একটা ঘর। পশ্চিমে একটি বেলজিয়াম আয়নার ড্রেসিং টেবিল। একটি শেলফে এখনো সাজানো আছে রূপার বাক্স, রবীন্দ্রনাথের রূপার গ্লাস এবং কয়েকটি বিলেতি শোপিস। তাছাড়া লম্বা একটি ঘরে দেখতে পাবেন রবি ঠাকুরের কলম। যে কলম দিয়ে তিনি রচনা করেছে হাজারো অমর সৃষ্টি। একটি ঘরের দেয়ালজুড়ে বড় বড় ছবি বাঁধানো। এখানে পর্যায়ক্রমে প্রিন্স দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি পর্যন্ত রয়েছে। সামনের বারান্দায় বিশেষ টেবিলে কাচে ঘেরা রয়েছে একটি ট্রেনের রেপ্লিকা। শান্তিনিকেতন থেকে শেষ এই ট্রেনে করে কবি জোড়াসাঁকো এসেছিলেন। ভারতীয় রেলওয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকে এটি উপহার হিসেবে দিয়ে ধন্য হয়েছে। পুরো বাড়িজুড়েই রয়েছে রবি ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন। চারপাশ দালানে ঘোরানো বাড়ির মাঝে উদোম উঠোন রয়েছে। যারা এই তীর্থস্থান ভ্রমণে আসেন তারা মূলত এই উঠোনে ছবি তোলেন। তাছাড়া মূল বাড়ির সামনের অংশ এবং ঠাকুরের মূর্তির ছবি তুলতে পারেন। কারণ বাড়ির ওপরতলার কোনো ছবি দর্শনার্থীরা নিতে পারেন না। ৩০ রুপিতে বাড়িতে ঢুকে আরও ৫০ রুপিতে একটি বিশেষ টোকেন মোবাইল অথবা ক্যামেরাই লাগিয়ে আপনি নিচতলার ছবি তুলতে পারবেন শুধু। চুপিসারে ওপরতলার ছবি তুলে কিংবা ভিডিও করে ধরা পড়লে দ্বিগুণ জরিমানা গুনতে হবে। গার্ডের তীক্ষ্ম দৃষ্টির সঙ্গে সিসি ক্যামেরার নজরদারি। তবে বাঙালিরা যে তার ফাঁক গলিয়ে দু-একটা ছবি তুলে আনেন না তা কিন্তু নয়। মূল বাড়িটি আয়তাকার। চারপাশে ঘোরানো বারান্দা। বারান্দা ধরে অনায়াসে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি চলে যাওয়া যায়।
প্রবেশপথে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ রয়েছে। বাড়ির অন্যপাশে রয়েছে ঐতিহ্যের লাল তোরণে লেখা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। তবে রবীন্দ্রভারতী গেইট হলো প্রধান ফটক। সেখান দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই পাবেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য। তার পাশ মাড়িয়ে আপনাকে দোতলায় উঠতে হবে। বাড়ির আয়তন ও কক্ষ দেখে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ঠিক কতোজন মানুষ থাকতো এই বিশাল বাড়িতে? মজার বিষয় হলো বাড়ি বিশাল হলেও সিঁড়ি কিন্তু সরু। তবে বাড়ির স্থাপত্যশৈলী আপনাকে মুগ্ধ করবে। দরজায় পিতলের কারুকাজ, সিঁড়ি, ভেতরের ঘরগুলোতে প্রকাশ পায় ঠাকুরবাড়ির রুচিবোধের পরিচয়। তিনতলায় রয়েছে ছাদ। তবে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নেই। দোতলায় রবীন্দ্রনাথ ও চীন সম্পর্ক নিয়ে সাজানো হয়েছে আলাদা একটি কক্ষ। তাছাড়া ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করে ইংরেজ সরকারকে লেখা চিঠি ঝুলছে একটি দেয়ালে। এই বর্জনের প্রতিক্রিয়া এবং প্রশংসা জানিয়ে বিশিষ্টজনদের লেখাও শোভা পাচ্ছে এখানে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, যে জমির ওপর আজকের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি তথা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে, সেই জমিটি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা দ্বারকানাথের ঠাকুরদাদা নীলমণি ঠাকুর গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন জিউয়ের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে লাভ করেছিলেন বিশিষ্ট ধনী বৈষ্ণবচরণ শেঠের কাছ থেকে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক ও আকাশপথে আপনি কলকাতা যাবেন। তাছাড়া আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা হয়েও প্লেনে কলকাতা যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনার খরচ কিছুটা কম পড়বে। আগরতলা সীমান্ত থেকে অটোরিকশায় মাত্র মিনিট ত্রিশের পথে বিমানবন্দর। ভাড়া পড়বে ১৩০-১৬০ রুপি। বিমানবন্দর থেকে নেমে ট্যাক্সিতে সরাসরি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। অথবা শহর ঘুরতে ঘুরতে মেট্রো রেলে নিউমার্কেট থেকে গিরিশপার্ক স্টেশন। সেখান থেকে ৭-৮ মিনিট হাঁটার দূরত্বে ঠাকুরবাড়ি। প্রবেশমূল্য ১০ রুপি। তাছাড়া ছবি তুলতে আলাদা ৫০ টাকা গুনতে হবে আপনাকে।
লেখক
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ইমেইল: Sameer.akhaura@gmail.com