ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মোঘলদের বিরুদ্ধে রাজা সীতারামের স্বাধীনতা সংগ্রাম

সাইফুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৪৭, ডিসেম্বর ৪, ২০১১
মোঘলদের বিরুদ্ধে রাজা সীতারামের স্বাধীনতা সংগ্রাম

‘জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে/ যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়, শত ধিক তারে। ’

দেশপ্রেমের মাতাল করা আবেগে ভরপুর মহাকবি মাইকেলের এ পংক্তি দু’টি দুনিয়ার সবকালের আর সবদেশের দেশপ্রেমিকদের মনের কথা।

স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালি কবির এ আবেগকে চিরকাল ধারণ আর প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বাঙালি বীররা তাদের শৌর্য-বীর্য আর অমূল্য জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে। দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাওয়া এমনি এক বীরের নাম রাজা সীতারাম দাস। তাকে নিয়ে আজকের এ লেখাটি তৈরি করেছেন সাইফুল ইসলাম

মুকুন্দরাম-সত্রাজিতের পতনের পর ভূষনা রাজ্যে [বর্তমান ফরিদপুর-মাগুরা] দেখা দেয় ভীষণ বিশৃঙ্খলা। মগ দস্যূদের অত্যাচারে রাজ্য হয়ে পড়ে জনশূণ্য, এবং এক পর্যায়ে জঙ্গলাকীর্ণ প্রায়। ঠিক ওই সময়েই আবির্ভাব ঘটে রাজা সীতারামের [১৬৫৮-১৭১৪]। তিনি মগ দস্যূ বিতারণে আর দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। সীতারামের নির্মাণ করা দূর্গসহ নানান কীর্তির ধংসস্তুপ আজো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভূষনা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে তৎকালীন ভূষনা রাজ্যের রাজধানী বর্তমান মাগুরার মহম্মদপুরে।

সীতারামের পিতা উদয় নারায়ণ ছিলেন ভূষনা রাজ্যের ফৌজদারের অধীনে সামান্য এক সাজোয়াল। তার মাতার নাম ছিল দয়াময়ী। ভূষনার পার্শ্ববতী গোপালপুর গ্রামে বসবাস করতেন তারা। ছেলেবেলায় পড়ালেখার পাশাপাশি সীতারামের প্রধান নেশা হয়ে দাঁড়ায় অস্ত্র শিক্ষা। তরুণ বয়সে এসে মগ দস্যুদের ত্রাস হিসেবে আবির্ভাব ঘটে সীতারামের।

১৬৬০ সালে মীর জুমলা যখন বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, তখন সীতারামের বাবা উদয়নারায়ণও সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খান বাংলার গভর্নর হন। এসময় উদয়নারায়ণ তার অধীন মোঘল সৈন্যবাহিনীতে তহসিলদার পদে উন্নীত হন এবং ভূষনায় স্থানান্তরিত হন। কয়েক বছর পর কাছেই মধুমতি নদীর তীরের হরিহরনগরে নিজ আবাস গড়ে পরিবারকে সেখানে নিয়ে আসেন উদয়নারায়াণ। সীতারাম পাঠশালায় সংস্কৃত শেখেন। সেময় স্কুল বা পাঠশালায় বাংলা শেখানো হতো না। তবে তিনি বাড়িতে বাংলায় বুৎপত্তি অর্জণ করেন। তার হস্তরেখা খুব আকর্ষণীয় ছিল। পরবর্তীতে তিনি তৎকালীন মোঘল সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সী শেখেন। মুসলমানদের সংস্পর্শে শেখেন উর্দু। তিনি অশ্বচালনা, তরোয়ালবাজি আর লাঠিখেলায় দক্ষতা অর্জণ করেন কৈশোরেই।

সুবাবাংলার রাজধানী ঢাকায় বেশ আসা-যাওয়া ছিল তরুণ বীর সীতরামের। ওই সময়ে কুখ্যাত দস্যু বক্তার খাঁকে পরাজিত করে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন তিনি। এতে করে ওই সময়ে গজিয়ে ওঠা ছোটখাট দস্যুরা সীতারামের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এসব খবর শুনে খুশী হন তৎকালীন বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ।

সেসময় করিম খাঁ নামে এক পাঠান বিদ্রোহীর তাণ্ডবে সাতাইর পরগনায় চরম অরাজকতা দেখা দেয়। বিষয়টা সুবাদারের জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দেয়। শায়েস্তা খাঁ সীতারামকে কয়েক হাজার পদাতিক আর অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে পাঠালেন করিম খাঁর বিরুদ্ধে। সীতারামের বীরত্বে করিম খাঁর বাহিনী নাস্তানাবুদ হয় এবং করিম খাঁ নিহত হন।

এ সাফল্যে শায়েস্তা খাঁ সন্তুষ্ট হয়ে সীতারামকে নলদী পরগনার জায়গির দিয়ে সম্মানিত করেন। এই একটি পরগনার কর্তৃত্ব থেকে থেকে ধীরে ধীরে একসময় আশপাশের ৪৪টি পরগনা নিজের আওতায় নিয়ে আসেন তিনি। এর আগে নলদী পরগনার জায়গীরদার হওয়ার পর থেকেই সীতারাম শুরু করেন নিজের একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ার কাজে।

১৬৮৪ সালে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর গয়ায় তীর্থযাত্রা করেন। এরপর ১৬৮৮ সালে দিল্লিতে মোঘল দরবারে হাজির হন। শায়েস্তা খাঁর সুপারিশ আর মোঘল দরবারে গিয়ে সাক্ষাতের ফলে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সীতারামকে ‘রাজা’ উপাধীতে ভূষিত করেন। এছাড়া তাকে সুন্দরবন পর্যন্ত দক্ষিণ বঙ্গ এলাকার দায়ত্ব দেওয়া হয়।  

চারন কবিরা এসময় সীতারামকে নিয়ে গান বাঁধেন, ‘ধণ্য রাজা সীতারাম, বাংলা বাহাদুর/ যার বলেতে চুরি-ডাকাতি হয়ে গেল দূর/ বাঘ-মানুষে একই সাথে সুখে জল খায়/ রামীশ্যামী পুটলি বাঁধি গঙ্গাস্নানে যায়। ’

তবে রাজা উপাধি এবং মোটামুটি একটা রাজ্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সীতারামের কোনও রাজধানী ছিল না।

জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, রাজধানীর জন্য সীতারাম খুঁজে বের করলেন খাল-বিল আর জলাভূমি বেষ্টিত একটি জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা, যা ছিল তৎকালীন সিদ্ধ পুরুষ দরবেশ মহম্মদ খাঁর এলাকা। তার নামানুসারে ওই এলাকাটি পরে মহম্মদপুর হিসেবে পরিচিতি পায় যা বর্তমানে মাগুরা জেলার একটি উপজেলা।

যাইহোক, দরবেশ সাহেবের কাছ থেকে রাজা সীতারাম ওই স্থানটি চেয়ে নিলেন। গড়লেন বিশাল দূর্গ যা ছিল দুই মাইল বিস্তৃত পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। রাজা দূর্গের চারপাশে ও ভেতরে খনন করলেন বেশ ক’টি দিঘি, এগুলোরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- রামসাগর, সুখসাগর ও কৃষ্ণসাগর। দূর্গের প্রবেশদ্বারের সামনেই ছিল রামসাগর, এসব জলাশয় পেরিয়ে শত্রুপক্ষের দূর্গে প্রবেশ ছিল প্রায় অসম্ভব।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, সুখসাগর দিঘির মাঝে ছিল একটি ছোট্ট দ্বীপ, যেখানে অবসর বিনোদন করতেন রাজা সীতারাম। মহম্মদপুরে বেশ ক’টি মন্দির গড়েন সীতারাম, এর একটিতে স্থাপন করা হয়েছিল লক্ষীনারায়ণের বিগ্রহ। কথিত আছে, এই বিগ্রহ চুরি করে নিয়ে যায় নড়াইলের জমিদারেরা। ওই বিগ্রহ আয়ত্ত করার পর থেকেই নাকি শনৈ শনৈ উন্নতি ঘটে তাদের।
 
জনশ্রুতি আছে, রাজা সীতারাম তার দূর্গ ছাড়াও রাজ্যজুড়ে অনেকগুলো দিঘি খনন করেছিলেন। এসব দিঘির কয়েকটিকে ঘিরে তার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হত। এক্ষেত্রে সীতারামের কৌশলটি ছিল অসাধারণ। প্রকাশ্যে সৈন্য সংগ্রহ করলে নবাবের সন্দেহ হতে পারে, এজন্য পুকুর খননের নামে চলত মজুর সংগ্রহ। পরে এদের মধ্য থেকে সৈন্য হিসেবে উপযুক্তদের বাছাই করা হতো। এসব সৈন্য তথা মজুরদের দিয়ে দিনে দিঘি খনন চলতো, রাতে চলতো তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ। এক দলের প্রশিক্ষণ শেষ হলে সেখানে এসে যুক্ত হতো আরেক দল। তার সেনাদলে যুক্ত হয় রামরূপ ঘোষ ওরফে মেনা হাতি। অসাধারণ রণ কুশলী মেনাহাতি একজন শক্তিশালী মল্লবীর ছিলেন। একবার খালিহাতে একটি ছোট হাতিকে হত্যা করার পর থেকে মেনা হাতি হিসেবে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।

এছাড়াও ইতিহাস এবং জনশ্রুতি থেকে তার সেনাদলে যুক্ত যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন- পাটান ডাকাত বক্তার খাঁ, মোঘল সেনা আলম বেগ, রূপচাঁদ ঢালী ও ফকিরা। রাজা সীতারাম এসময় ঢাকার জনার্দণ [যিনি নবাবের কামান তৈরি করতেন] কামারের জ্ঞাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে আসেন মহম্মদপুরে। তাদের দিয়ে তৈরি করালেন বড় বড় কামান। সীতারামের রাজ্যের বিস্তৃতি ভাটি অঞ্চল জুড়ে অর্থাৎ উত্তরে পদ্মার পাড় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর (বর্তমান সুন্দরবন তথা বাগেরহাট জেলা) পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে, সকল প্রস্তুতি শেষে এক সময় রাজা সীতারাম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ফৌজদার তরফ খাঁকে জানিয়ে দিলেন যে দিল্লীর বাদশা বা নবাবকে তিনি আর খাজনা দেবেন না।

শুধু তাই নয়, মোঘলদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে একসময় সীতারামের নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতি মুনিরাম ঘোষ ওরফে মেনা হাতির হাতে নিহত হন ফৌজদার তোরাব খাঁ। ফলে সীতারামের সঙ্গে মোঘলদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠলো। এসময় মুর্শিক কুলি খাঁ তার ভগ্নিপতি বক্স আলী খাঁকে তোরাব খাঁর শূন্য পদে স্থলাভিষিক্ত করেন।

কথিত আছে, রাজা সীতারামকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেরণ করা হয় মোঘল অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি পীর খানকে। এদিকে সীতারামের সৈন্যরা পীর খান মনে করে হত্যা করে সম্রাটের নিকটাত্মীয় আবু তোরাবকে। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ আরো সৈন্য প্রেরণ করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সীতারামের শত্রু ভুষনার পাশর্^বর্তী জমিদাররাও।

সুবা বাংলার মোঘল সেনাপতি সংগ্রাম সিং ও বক্স আলী খান বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পদ্মার তীর ফরিদপুরের কাছে ভূষনার যুদ্ধে পরাজিত হন সীতারামের কাছে।

এরপর মোঘল বাহিনী ভূষনায় সীতারামের দূর্গ অবরোধ করে। নাটোর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দনের সেনাপতি দয়ারাম রায়ও সৈন্য সামন্ত নিয়ে এ যুদ্ধে মোঘলদের পক্ষে অংশ নেন। সম্মুখ সমরে মেনা হাতিকে হারানো প্রায় অসম্ভব- একথা মাথায় রেখে এসময়ে দয়ারাম কূট-কৌশলের আশ্রয় নেন। তার প্ররোচনায় এক অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনায় সীতারামের সেনাধ্যক্ষ মেনা হাতি নিজের লোকের হাতে নিহত হন। দয়ারাম তার কর্তিত মস্তক মুর্শিদাবাদে পাঠান।

এদিকে, মেনা হাতির মৃত্যুর ফলে শক্তিশালী মহম্মদপুর দুর্গ প্রায় মোঘলদের হাতে চলে আসে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ভূষণা ছেড়ে সীতরাম মহম্মদপুরের দিকে অগ্রসর হন। বক্স আলী খানও ছুটে আসেন সৈন্য সামন্তসহ সীতরামকে প্রতিরোধ করতে। সীতরাম দূর্গ থেকে নিজের পরিবারসহ বেসামরিক নাগরিকদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেন।

অপরদিকে দয়ারাম পূর্ব ও বক্স আলী দক্ষিণ দিক থেকে মহম্মদপুর দূর্গ আক্রমণ করেন। একের পর এক যুদ্ধে মোঘল আর স্থানীয় প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এবং মেনা হাতিসহ নির্ভরযোগ্য লোকদের হারিয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে এসেছিলেন সীতারাম।

এরই ধারাবহিকতায় প্রচণ্ড যুদ্ধের একপর্যায়ে মহম্দপুর দুর্গের পতন হয়। রাজা সীতারাম সপরিবারে বন্দি হন। দয়ারাম তাকে শিকলবন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। সেখানে ১৭১৪ সালে মুর্শীদ কুলী তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এ বীরের জীবনাবসান ঘটে। মুর্মিদাবাদে গঙ্গার পাড়ে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।

যুগে যুগে স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আরো এক ‘চির উন্নত শির’ রাজা সীতারাম ইতিহাসের গৌরবজনক স্থানে নিজের নামকে এভাবে অমর করে রাখলেন।  

(তথ্য সূত্র: আনন্দনাথ রায় লিখিত ফরিদপুরের ইতিহাস, উইকিপিডিয়া)

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৭ ঘণ্টা, ০৪ ডিসেম্বর, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।