ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সংবাদপত্রে ১৯৭১

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১২, ডিসেম্বর ১৫, ২০১১
সংবাদপত্রে ১৯৭১

ভুটানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় হিমালয় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্র ভুটান।

১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের এক কোণায় খুব ছোট্ট একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান’। একই সঙ্গে ওই দিনই দৈনিক ইত্তেফাকের আরেকটি সংবাদ ছিল ‘বাংলা দেশের প্রতি ভারতীয় স্বীকৃতিতে চীনের নিন্দা। ’ সে সময় অধিকাংশ পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ’কে লেখা হতো ‘বাংলা দেশ’।

যাহোক, সংবাদপত্রে একাত্তর বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। তবে এটাও ঠিক ইতিহাসের সঙ্গে সংবাদপত্রের সম্পর্ক অতি নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ। ইতিহাসচর্চা কিংবা রচনা দু’টি ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রের গুরুত্ব থাকবে। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য কিংবা বোঝার জন্য তৎকালীন সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক। এ বছরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বিষয় হিসেবে পেয়ে যাই ১৯৭১ সালের সংবাদপত্রের ভূমিকা নিয়ে কাজ করার সুযোগ। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভে যাই আমি ও রেজওয়ান আহমেদ। রেজওয়ান এ গবেষণায় আমার সহযোগী। যিনি উদ্যোক্তা তিনি আমার শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মাদ আনোয়ার। যুদ্ধে সংবাদপত্রেরও ভূমিকা আছে; এ বিষয়টি নিয়ে স্যারই প্রথম কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অধ্যাপক আনোয়ার ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ-এর প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত। তাঁর দিকনির্দেশনায় চলে আমাদের কাজ।

আমি ও রেজওয়ান একাত্তরের সংবাদপত্রগুলো নিয়ে বসেই কখনো চমকে উঠি; কখনো শিহরিত হই। আমাদের সামনে স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধ কোনো দল বা কোনো ব্যক্তির জন্য ছিল না। আমরা এও বুঝি এটা ছিল সময়ের দাবি। পুরো জাতি স্বাধীনতার সংগ্রামে মাতাল হয়ে পড়েছিল। সেসব সংবাদের বিচ্ছিন্ন কিছু অংশ নিয়েই আমার এই লেখা।

আমি ৮ মার্চের পত্রিকা দিয়েই শুরু করি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরদিন ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি যদি-’। ভেতরে আছে বঙ্গবন্ধুর শর্তগুলো ও ভাষণের বিবরণ। তবে এক্ষেত্রে ‘দৈনিক সংবাদ’ ছিল এগিয়ে। সরাসরি স্বাধীনতার স্লোগানই ঠাঁই পেয়েছিল শিরোনামে। দৈনিক সংবাদের ৮ মার্চের শিরোনাম ছিল ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম: মুজিব’।

তবে দুঃজনক বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুর পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৯ মার্চ, ১৯৭১ আরেকটি ভাষণ দেন। ২ নেতার এক কাতারে চলে আসার একটা নজির স্থাপিত হয়। কিন্তু এ নজিরটি ইতিহাসের পাতায় অনেকটাই অনুপস্থিত হিসেবে আমরা দেখতে পাই। ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘মুজিবের সঙ্গে একযোগে আন্দোলন করিব: ভাসানী’। এ সংবাদের শুরুর লাইনগুলো তুলে দিলাম,

‘অশীতিপর বৃদ্ধ রাজনৈতিক নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গতকাল (মঙ্গলবার) পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে অবিলম্বে বাংলার স্বাধীনতা প্রদানের জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহবান জানান। মাওলানা বলেন, ১২ মার্চের মধ্যে যদি স্বাধীনতা দেওয়া না হয় তাহা হইলে আমি ও শেখ মুজিব পুনরায় ১৯৫২ সানের মত একযোগে আন্দোলন করিব- প্রধানমন্ত্রী হইতে আমরা যাইব না। ...’

সে সময়ের উল্লেখযোগ্য ২ নেতা যখন একই কাতারে দাঁড়িয়ে যান তখন জনতার সামনে স্বাধীনতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ থাকে না; এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি জাতি তখন থেকেই পূর্ণ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। আমাদের সংবাদপত্রগুলোও সেই স্বপ্নই মানুষকে দেখায়। সাহস দেয়। বাঙালি জাতির জাগরণের নেতা শেখ মুজিবের নানা কথা মালা জায়গা নেয় পত্রিকা জুড়ে। যেমন, ১৫ মার্চ দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বাঙালীরা নতি স্বীকার করিবে না: মুজিব’। অন্যদিকে ১৯ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘এ গণবিস্ফোরণ মেশিনগানেও স্তব্ধ করা যাইবে না’। এমন শিরোনাম মানুষের মনকে যে জাগিয়ে তুলতে পারে তা অবলীলায় বলে দেওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর থেকেই বাঙালি জাতি সব রকমের আক্রমণের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়গুলোর উপরও জোর দেয়। যেমন, ২১ মার্চ দৈনিক সংবাদের ভেতরের পাতায় সব জেলার আন্দোলন, বিক্ষোভের সংবাদগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল ‘মোদের হাড় দিয়ে ভাই জ্বালবো এবার মুক্তির বজ্রানল’।

২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার পর পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে। সরকারি পত্রিকা এবং রাজাকার আলবদর কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ হয়। তবে ইত্তেফাক প্রকাশ হওয়া শুরু করে অক্টোবর মাস থেকে। দৈনিক সংবাদের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। জাতীয় আর্কাইভে যুদ্ধকালীন দৈনিক সংবাদের কোনো কপি পাওয়া যায়নি।

অক্টোবর থেকে দৈনিক ইত্তেফাক দেখলে দেশে যুদ্ধের পরিস্থিতি বোঝার উপায় নেই। তারপরও খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সরকারের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিয়ে ইত্তেফাক প্রকাশ করে যুদ্ধের টুকরো টুকরো খবর।

রাজাকার নিয়ে বহু সংবাদ পাওয়া যাবে ১৯৭১ সালের সংবাদগুলোতে। সরকারি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানে ১১ এপ্রিল শিরোনামই ছিল ‘ঢাকায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত’। আবার ১২ মে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ‘আরো কতিপয় স্থানে শান্তি কমিটি গঠন’ শিরোনাম সংবাদের ভেতর উল্লেখ আছে বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি গঠনের কথা। এমনকি যারা যারা শান্তি কমিটিতে আছে তাদের নামও উল্লেখ আছে এতে।

পত্রিকাগুলো দেখলে আরো জানা যায়, পাকিস্তানি শাসক ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় এজেন্ট বলে উল্লেখ করত। যেমন, ১৯ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘রাজাকার তৎপরতা’ শিরোনামে সংবাদটি ছিল,

‘গতকাল রাজাকাররা রাজশাহী ও যশোরে ২টি পৃথক সংঘর্ষে ২ দল ভারতীয় এজেন্টের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দেয়। রাজশাহী হইতে প্রাপ্ত এক খবরে বলা হয়: গতরাত্রে বড়াই গ্রামে টহলদানরত রাজাকাররা দেখিতে পায় যে, প্রায় ৩০ জন ভারতীয় এজেন্ট লুটপাট করার উদ্দেশ্যে ঐ গ্রামে ঢুকিতেছে। তখন তাহারা ভারতীয় এজেন্টদের প্রতি গুলীবর্ষণ শুরু করে এবং যতবারই তাহারা গ্রামে প্রবেশের চেষ্টা করে ততবারই রাজাকারগণ তাহাদের বাধা দান করে। ইহাতে ৪ জন ভারতীয় এজেন্ট নিহত হয় এবং তাহাদের নিকট হইতে ৪ শত ২ রাউন্ড গুলীসহ ৪ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ...’  

মুক্তিযুদ্ধের সময় কিংবা তার আগে পত্রিকাগুলো বড় ভূমিকা রেখেছে। তারাও যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সে সময়কার সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। কিন্তু তাদের কথা ইতিহাসে খুব একটা উঠে আসে না।

সত্যিকথা বলতে কী, মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস এতটাই ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিস্তৃত যে, জনগণ-রাজনৈতিক দল-ব্যক্তি, বেসামরিক-আধা সামরিক-সামরিক বাহিনী, বুদ্ধিজীবী-গবেষক, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক-জনতা, সাংবাদিক, নারীসমাজ সকলেরই যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও ভূমিকার নিদর্শন রয়ে গেছে। আর এ সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে সংবাদপত্রে। যে কাল যে যুগই হোক না কেন। সময় ও ইতিহাস রক্ষিত থাকে সংবাদে। সম্ভবত এ কারণেই এম.ভি. চার্নলি বলেছেন, ‘সংবাদ হলো আজকের মোড়কে দেওয়া আগামী দিনের ইতিহাস। ’

বাংলাদেশ সময়: ২২১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।