ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া সুনীল গাঙ্গুলীর গল্প

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৯
বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া সুনীল গাঙ্গুলীর গল্প ‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’খ্যাত সুনীল কুমার গাঙ্গুলী। ছবি: বাংলানিউজ

গোপালগঞ্জ: ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন। সেগুলো হলো- বই, বই এবং বই’। বহু বছর আগে এমন কথাই বলেছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তবে বিংশ শতাব্দিতে এসে মানুষের বই পড়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে। দেশের অনেক গুণীজনই বলে থাকেন, এখন নাকি মানুষের মাঝে বই পড়ার প্রবণতা একেবারে নেই বললেই চলে।

তবে এমন সময়ে এসেও মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দিচ্ছেন ‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’খ্যাত গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম কুমরিয়ার বাসিন্দা সুনীল কুমার গাঙ্গুলী। পড়া শেষ হলে আবার নিজে গিয়েই বই ফেরত নিয়ে আসেন।

বিগত ২১ বছরে বদলেছে চারপাশের কতকিছুই। নিজের বয়সও পেরিয়ে গেছে ৬০। কিন্তু বদলায়নি সুনীল কুমারের বই পৌঁছে দেওয়ার এই অভ্যেস।

এছাড়া নিজ উদ্যোগে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘চন্দ্রিকা জ্ঞান’ নামক পাঠাগার। বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি নিজ পাঠাগারে বই পড়ার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

১৯৭৫ সালের মাদারীপুর জেলার (বর্তমান) রাজৈর মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন সুনীল কুমার গাঙ্গুলী। ইচ্ছা থাকার পরও অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কারণে পড়াশোনায় আর এগোতে পারেননি তিনি। তাই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই ১৯৮৬ সালে বিনা বেতনে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার ঘাঘর থানা সদর রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। দীর্ঘ ৪ বছর পর ১৯৯০ সালে সামান্য কিছু ভাতা পাওয়া শুরু করেন। ২০১৩ সালে স্কুলটি সরকারিকরণ হয় এবং ২০১৫ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নেন তিনি।  

১৯৯৮ সালে শিক্ষকতা পেশায় থাকাকালীন ৫০ খানা বই নিয়ে স্বল্প পরিসরে তিনি এ মহতী কার্যক্রম শুরু করেন। অবসরে যাওয়ার পর ২০১৫ সালে তিনি চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগারের মাধ্যমে বইয়ের পরিসর বাড়ান।

বর্তমানে তার পাঠাগারটিতে ৬শ’ বই আছে। তার পাঠাগারে বিভিন্ন মনীষী, বিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিকের জীবনী, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা, ধর্মীয় বইসহ বিভিন্ন শ্রেণীর বই রয়েছে। আর পাঠাগারটিতে প্রায় হাজার খানেক পাঠক রয়েছে। তবে, বইয়ের স্বল্পতা, প্রায়োজনীয় বুক সেলফ ও আসবাবপত্র না থাকায় তার এ মহতী কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান জ্ঞানের ফেরীওয়ালা সুনীল কুমার গাঙ্গুলী। তাই এ কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত ও গতিশীল করতে তিনি সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন।

নিজের পাঠাগারে বসে সুনীল কুমার গাঙ্গুলী।  ছবি: বাংলানিউজ

সুনীল কুমার গাঙ্গুলী বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষা জীবনে বই পড়ার প্রতি আমার অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কারণে সুযোগ হয়নি। তাই তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল এমন একটি উদ্যোগ নেবো যাতে মানুষ বিনামূল্যে বই পড়ার সুযোগ পায়। কর্মজীবনে ঢোকার পর থেকেই সেই চেষ্টা করছি। সুযোগ হলেই বই কিনেছি বা সংগ্রহ করেছি। সেই বই নিজেও পড়েছি, আবার অন্যদের পড়ার জন্যও ধার দিয়েছি। এভাবেই শুরু হয় আমার মনের বাসনা পূরণ। আর এখন এ কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি।  

‘কিন্তু আমার ইচ্ছা, যাতে পাঠাগারটিতে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বসে বই পড়তে পাড়ে, জ্ঞান অর্জন করতে পারে। তাই সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছি,’ যোগ করেন তিনি।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিজলবাড়ী বিনয় কৃষ্ণ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বিপিং বিহারী বিশ্বাস (৭৫) বাংলানিউজকে বলেন, অসুস্থ শরীরেও সুনীল কুমার গাঙ্গুলী যে মহৎ ব্রত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই সরকার তার এই প্রচেষ্টায় পৃষ্ঠপোষকতা করুক। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তিনি বই পৌঁছে দিচ্ছেন। আবার পড়া শেষ হলে নিজেই গিয়ে নিয়ে আসছেন। তিনি শুধু নিজের ইউনিয়নেই নয়, আশপাশের আরও ৪-৫টি ইউনিয়নে এ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দিচ্ছেন সুনীল কুমার গাঙ্গুলী।  ছবি: বাংলানিউজ

কুমরিয়া গ্রামের গৃহিণী রত্না বিশ্বাস (৩৬) বাংলানিউজকে বলেন, আমাকে সুনীল কুমার গাঙ্গুলী বাড়িতে এসে বই পৌঁছে দিয়ে যান। আমি উনার কাছ থেকে গান, ছড়া আর কবিতার বই নেই। এসব বই আমি আমার ছোট বাচ্চাদের পড়ে শুনাই।

কোটালীপাড়া শেখ লুৎফর রহমান ডিগ্রী কলেজের অনার্স (বাংলা) প্রথম বর্ষের ছাত্রী তপু বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন বইয়ের প্রয়োজন হয়। আমরা যারা শিক্ষার্থী আছি তারা সুনীল কুমার গাঙ্গুলীর কাছ থেকে বই এনে পড়ি। কিন্তু উনার পাঠাগারে বইয়ের সংকট রয়েছে।  

‘এছাড়া প্রয়োজনীয় বুকশেলফ এবং টেবিল-চেয়ার না থাকায় শিক্ষার্থীরা সেখানে বসে বই পড়তে পারেন না। তাই উনার মতো একজন সৃষ্টিশীল ও শিক্ষানুরাগী মানুষকে বিত্তবানদের সহযোগিতা করা উচিত। তার এই কার্যক্রমের মাধ্যমে বই পড়ার প্রতি মানুষের আবার আগ্রহ ফিরে আসবে। ’

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লোপা বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, সুনীল কুমার গাঙ্গুলী শুধু বই-ই পৌঁছে দেন না, তিনি মেয়েদের মন দিয়ে বেশি বেশি পড়াশোনা করতে বলেন। মেয়েরা যাতে অল্প বয়সে বিয়ে না করে, সেই জন্যও কাজ করেন। তিনি আমাদের অভিভাবকদের সব সময় পরামর্শ দেন, মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে বিয়ে দিতে হবে। তাহলে কোনো মেয়েই ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে না। সত্যিই তিনি একজন অনুকরণীয় মানুষ।

কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এমন একটি উদ্যোগের কথা শোনার পর আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সুনীল কুমার গাঙ্গুলী একজন সাদামনের মানুষ। পরোপকার করাই তার কাজ। আমাদের দেশে এমন মানুষের খুবই প্রয়োজন। পাঠাগারটিতে আরও কী কী সহযোগিতা করা যায় সেটি আমরা দেখছি। উনার উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৯
এসএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।