বলা হয়, নূহের নৌকা ছিল পৃথিবীর প্রথম জলযান। ধর্মগ্রন্থের সূত্রে সবাই জানে নূহের নৌকার কথা।
১৯৫৯ সালে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ের ওপরে হুবহু জাহাজ আকৃতির একটি জায়গার সন্ধান পান ক্যাপ্টেন ইলহান দুরুপিনার নামে এক মানচিত্রকর। বিশ্বাসীরা দাবি করে সেটিই নূহের নৌকার ধ্বংসাবশেষ। বাইবেল অনুসারে প্লাবন শেষে ওই অঞ্চলের আরারাত পর্বতেই তার নৌকা গিয়ে ঠেকে। দুরুপিনা ওই অঞ্চল আবিষ্কার করায় জায়গাটির নামও হয় দুরুপিনার।
এদিকে দুরুপিনারের ওই নৌকা আকৃতির জায়গাটিকে নূহের নৌকার ধ্বংসাবশেষ মানতে নারাজ ভূতত্ত্ববিদরা। তাদের মতে, ওই জায়গাটি আসলে পাহাড়েরই অস্বাভাবিক এক ধরনের ভাঁজ। যার ফলে এটিকে দেখতে নৌকার মতো মনে হয়। কিন্তু, অনেক বিশ্বাসীই তাদের দাবিতে অনড়।
সম্প্রতি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধানকারী একটি বিশেষজ্ঞ দল জানিয়েছে, সম্ভবত তারা দুরুপিনারে নূহের সেই ঐতিহাসিক নৌকার সন্ধান পেয়েছেন। আগামীতে এ ব্যাপারে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করা হবে।
দীর্ঘদিন ধরে নূহের নৌকার অনুসন্ধান চালানো ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার সেম সেরতেসেন জানান, দুরুপিনারের নিচে কী আছে সে ব্যাপারে ত্রিমাত্রিক ছবি সংগ্রহ করেছে তার দল। তারের মাধ্যমে ভূগর্ভে বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠিয়ে এসব ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। সামনেই একটি ডকুমেন্টারিতে এ বিষয়ক রহস্যের সুরাহা হবে।
সেরতেসেন বলেন, এগুলোই দুরুপিনার নৌকার আসল ছবি। মাটির নিচে পুরো নৌকাটি চাপা পড়ে আছে। এগুলো মোটেই ভুয়া নয়।
এর আগে ২০১৭ সালে নূহের নৌকা বিষয়ক আরও একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেন এ ফিল্মমেকার।
তিনি বলেন, যদিও এখনই ছবি দিয়ে নিশ্চিতভাবে এটা প্রমাণ হয় না যে, এটিই নূহের সেই নৌকা। হতে পারে এটি অন্য কোনো নৌকা। তবে এটি যে নৌকা সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।
ত্রিমাত্রিক ছবিগুলো প্রকাশ পেলেই বোঝা যাবে, বিশ্বাসীদের মতে দুরুপিনার সত্যিই কোনো পবিত্র জায়গা কিনা। সেরতেসেনের ডকুমেন্টারি দলের হয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ও প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যান্ড্রিউ জোনস এবং ভূতত্ত্ববিদ জন লারসেন এসব ছবি সংগ্রহ করেছেন।
কবে নাগাদ সেরতেসেন’র ডকুমেন্টারিটি প্রকাশ পাবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু জানাননি তিনি।
তবে এটিই যে নূহের নৌকার অনুসন্ধান বিষয়ক একমাত্র দাবি, তা নয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।
এর আগে ২০০০ সালে মার্কিন সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম রায়ান ও ওয়াল্টার পিটম্যান দাবি করেন, আজকের ৪ লাখ ৩৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের বিশাল কৃষ্ণসাগর (ব্ল্যাক সি) ২০ হাজার বছর আগে মূলত একটি ছোট্ট দীঘি ছিল। ১২ হাজার বছর আগে সমাপ্ত শেষ বরফ যুগে হিমবাহ গলতে শুরু করলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। সে সময় ছোট্ট সেই দীঘি পরিণত হয় সুবিশাল সাগরে।
এ দুই সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদের ধারণা, কৃষ্ণসাগরের তলদেশ একসময় শুষ্ক ছিল। সেখানে জনবসতি থাকার প্রমাণ পেয়েছেন বলেও দাবি করেছেন তারা। তাদের মতে, মহাপ্লাবনের আগে সম্ভবত ওই অঞ্চলেই নূহ নবীর সম্প্রদায় বাস করতো।
২০০০ সালে উইলিয়াম রায়ান ও ওয়াল্টার পিটম্যানের এ দাবির পর বেশ কিছুকাল চলে যায়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে বুলগেরিয়ার নেসেবার উপকূলে কৃষ্ণ সাগরের এক হাজার থেকে ছয় হাজার ফুট গভীরে প্রাচীন এক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। অনেক গভীরে অক্সিজেনের পরিমাণে কম থাকায় সাগরের জলে ডুবে থাকার পরও দীর্ঘকালেও নিশ্চিহ্ন হয়নি জাহাজটি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওই জাহাজটিই সমাধান দিতে পারে নূহের নৌকার রহস্যের। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনে ‘ব্ল্যাক সি ম্যারিটাইম আর্কিওলজিক্যাল প্রজেক্ট’র (এমএপি) গবেষকরা ওই জাহাজের ধ্বংসাবশেষগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তারা জানান, এখনো এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি যাতে বলা যায়, হঠাৎ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে কৃষ্ণসাগরের ওই অঞ্চল। বরং সেখানে পানির উচ্চতা বেড়েছে ধীরে ধীরে। তাদের মতে, রায়ান ও পিটম্যানের হঠাৎ বন্যায় কৃষ্ণসাগর সৃষ্টির দাবি সঠিক নয়। তবে, জাহাজের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে।
এর আগে খ্রিস্টান অভিযাত্রীদের একটি দল দাবি করেছিল, ৯৯.৯ শতাংশ সম্ভাবনা আছে যে, তুরস্কের আরারাত পর্বতের বরফের নিচেই আছে ঐতিহাসিক সেই নূহের নৌকা।
এছাড়া নূহের নৌকার অনুসন্ধানে থাকা হংকংভিত্তিক ডকুমেন্টারি টিম ‘নোয়াহস আর্ক মিনিস্ট্রিস ইন্টারন্যাশন্যাল’র দাবি, তারা এমন একটি কাঠের টুকরো পেয়েছে, যার কার্বন পরীক্ষায় প্রমাণ মিলেছে যে, সেটি ৪ হাজার আটশ’ বছরের পুরনো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ফুট ওপরে ওই কাঠের টুকরাটি পাওয়া যায় বলে জানায় তারা।
বাইবেলের বুক অব জেনেসিসের তথ্য অনুসারে, মহাপ্লাবনের পর তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত আরারাত পর্বতে গিয়েই ঠেকেছিল নূহের নৌকা। যদিও অসংখ্য অভিযানের পরও এ তত্ত্বের সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৯
এফএম/এইচজে