উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ফিরে: বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে ব্যাপক আলোচিত ইস্যু-জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়। সমগ্র বিশ্বজুড়ে এই ইস্যুটিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে।
আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, জনস্বাস্থ্য, বাসস্থান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে নানামূখি বিপর্যয় দেখা দেবে। এরই মধ্যে সীমিত পরিসরে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। নিকট ভবিষ্যতেই এ সংকট আরো তীব্র আকারে দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য এই সংকট মোকাবেলায় আমরা কতটা সামর্থ্য অর্জন করেছি কিংবা আমাদের সীমাবদ্ধার প্রকৃত চিত্রটিইবা কী রকম-সেটা মূল্যায়ন এই মুহুর্তে জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: বিজ্ঞানের ভাষায় কোন অঞ্চলের ২/৩ যুগের গড় আবহাওয়াকে সে অঞ্চলের নির্দিষ্ট জলবায়ু বলা হয় । প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হলেও মানবসৃষ্ট নানা কারণে জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, সে বিষয়টি ১৮৯৬ সালে সর্বপ্রথম সকলের গোচরে আনেন সুইডিশ রসায়নবিদ সেভানতে অরহেনিয়াস। পরিবেশ রক্ষার কথা বিবেচনা না করে দ্রুত বিকাশ লাভ করা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে পৃথিবীকে বসবাস অযোগ্য করে তুলছে--অরহেনিয়াসের এমন দাবিকে আমলে নিতে চাননি প্রথমে অনেকেই।
প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অব অসেনোগ্রাফি-তাঁর এই দাবির সত্যতা পান। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্ত:সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) পরিসংখ্যান মতে, গত একশ’ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৭৪ সেন্টিগ্রেড। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ি, হিমালয় পর্বতের হিমবাহগুলো বছরে ২৩ মিটার করে কমে যাচ্ছে। এই হিমবাহ থেকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও চীনের নদীগুলোতে মিঠা পানি আসতো। বর্তমানে এসে তা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপের আল্পস পর্বতমালাতেও। এভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে এক থেকে দেড় মিটার। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অপর দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ তলিয়ে যাবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নিম্ন উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ লবণাক্ত পানির নীচে তলিয়ে যাবে।
চলমান সংকট: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে বড় ধরণের বিপর্যয় এখনো শুরু না হলেও প্রাথমিকভাবে অনেক সংকট দেখা দিয়েছে। সেসব ছোট সংকট গুলোও আমাদের মতো দারিদ্র্রপীড়িত দেশের জন্য অনেক বেশি ঝূঁকি তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয়ের হিমবাহ থেকে মিঠা পানির প্রাপ্যতা কমেছে, অন্যদিকে উজানের নদীগুলোতে বাঁধ দেয়ার ফলে মিঠা পানির প্রবাহ উদ্বেগজনক হারে কমে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলায় উপকূলীয় বিস্তীর্ণ জনপদে লবণ-পানি ঢুকে পড়ে। নদীগুলো নাব্যতা হারানোর কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘুর্ণিঝড়ের সময় প্রবেশ করা লবণ-পানি বের হতে পারেনি, পূর্বে যেটা মিঠা পানির সংস্পর্শে সাগরে ফেরত যেত। উপকূলীয় এলাকায় অপরিকল্পিত ভাবে চিংড়ি চাষের জন্য লবন পানি কৃষিভূমিতে কৃত্রিমভাবে ঢুকিয়ে এসব সংকটকে আরো তীব্রতর করে তুলেছে।
দেশের উপকূলীয় ১২টি জেলার প্রায় ২০টি উপজেলার মানুষ এখন লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাবের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করে টিকে আছে। সেসব জমিতে লবণসহিষ্ণু নয় এমন কৃষি আবাদ সম্ভব হচ্ছে না। মাঠের পর মাঠ অনাবাদি পড়ে রয়েছে। কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল সেই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠি এখন জীবিকা হারিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে শহরে, সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক সমস্যার।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনিস্টিটিউটের ২০১০ সালের প্রকাশিত জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৩৬ বছরে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ২ হাজার দশমিক ৮১ হেক্টরে। বৃদ্ধির হার শতকরা ২৬.৭ ভাগ। ১৯৭৩ সালে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮লাখ ৩৩ হাজার দশমিক ৪৫ হেক্টর। ২০০০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ২০ হাজার দশমিক ৭৫ন হেক্টর। মাত্র এক যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ২০০৯ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার দশমিক ২৬ হেক্টর, অর্থাৎ ৯ বছরে বাড়ে ৩৫ হাজার দশমিক ৫১ হেক্টও ( বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ)।
দেশের উৎপাদিত খাদ্যের এক বিরাট অংশই ফলতো উপকূলীয় এই এলাকাগুলোতে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ওইসব অঞ্চলে কৃষি আবাদ ব্যাহত হওয়ায় দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি গবেষণার মাধ্যমে লবণসহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণ করে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন এখনো খুবই সীমিত পরিসরে রয়েছে। সার্বিক সংকট মোকাবেলায় অভিযোজন কৌশল এই মুহুর্তেই বড় কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ঋতুর বৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা ইত্যাদি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুকনা মৌসুমে দেশের খরাপ্রবণ এলাকা প্রায় ৩৬০০ বর্গকিলোমিটার, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এর পরিমাণ আরো বেড়ে ২২০০ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়াতে পারে। ফলে এটিও লবণাক্ততার মতো খাদ্য উৎপাদনে এক বড় বাঁধা হিসেবে দেখা দেবে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের এক অন্যতম আধার সুন্দরবন। ভৌগোলিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপুল সম্পদের আধার সুন্দরবন দারুণ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কারণ বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এর অবস্থান হওয়ায় বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করা ছাড়াও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে তার বড় শিকার হবে সুন্দরবন। পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বনের সিংহভাগ অংশ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া লবণাক্ততা বাড়ার ফলে মিঠাপানি-নির্ভর বনের বিপুল বৃক্ষরাজি ও প্রাণি বৈচিত্রকে বাঁিচয়ে রাখা কঠিন হবে। এরই মধ্যে ব্যাপক হারে সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী গাছের মড়ক ভাবিয়ে তুলছে বিষেশজ্ঞদের। তাছাড়া সুন্দরবনের সাহচর্যে থাকা নদীগুলোতে মিঠা পানির প্রাপ্যতা দিন দিন কমছে, যার প্রভাবে লবণ-পানি সহনশীল নয় এমন মাছ ও অন্যান্য প্রাণি, যেমন-প্যাগাসাস পেঙ্গুইন, কচ্ছপ ইত্যাদি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের এই আশঙ্কাজনক ক্রমাবনতি প্রভাব ফেলছে পুরো ইকো সিস্টেমে।
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বাংলাদেশের সুপেয় পানির পরিমাণ দিন দিন কমছে। সমুদ্রপৃষ্ঠে উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা বাড়ার ফলে উপকূলীয় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ এখন খাওয়ার উপযোগী পানির তীব্র সংকটে ভুগছেন। ধীরে ধীরে এ সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। বর্তমানে আর্সেনিক সমস্যার সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে উত্তরাঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত বিশাল জনগোষ্ঠি। কারণ পানি পরিশোধন করে খাওয়ার সামর্থ্য কিংবা সচেতনতা কোনটাই নেই তাদের । এসব সংকট নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য হুমকি ভাবিয়ে তুলছে গবেষকদের। উপকূলীয় এলাকাগুলোর মানুষদের মাঝে নানা ধরণের রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।
ভবিষ্যত ভয়াবহতা: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সবচে’ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে চিহ্নিত করে সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিরূপণ করেছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)’র মতে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষ স্থানে রয়েছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে দেড় মিটার, এর ফলে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল অর্থাৎ মোট ভূখন্ডের এক তৃতীয়াংশ পানির নীচে তলিয়ে যাবে। বাড়ি ঘর ও অন্যান্য সম্পদ হারিয়ে জলবায়ু-উদ্বাস্তু হবে কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ। এমনিতেই প্রতি বছর দেশের মোট ভূমির ১ শতাংশ কমছে শিল্প, অবকাঠামো ও অন্যান্য উন্নয়ন কাজে। কমছে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কৃষি জমি।
অপরদিকে, উপকূলীয় বিশাল উৎপাদনশীল ভূমি পানির নীচে তলিয়ে গেলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় যোগ হবে বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে ব্যাপক হারে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ ও আহরণ ও অন্যান্য বিভিন্ন পেশায় জীবিকার সংস্থান করা বিপুল জনগোষ্ঠি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কাজ হারাবে। ফলে দেশে বেকার জনগোষ্ঠির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে। বিকল্প কর্মসংস্থান করা না গেলে দেশে সামাজিক অপরাধ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি বৃদ্ধি পাবে। সামগ্রিক ভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খারাপের দিকে যাবে।
সংকট উত্তরণে করণীয় ও বিশেষজ্ঞদের মতামত: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সামগ্রিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বড় ধরণের বাধা জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়। বহু পূর্ব থেকেই এই ইস্যুতে যতটা পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল তা হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারসহ বেসরকারি ভাবে বিষয়টি নিয়ে নানামুখি তৎপরতা শুরু হলেও তা অনেক বিলম্ব হয়েছে বলে অভিমত তাদের।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার সংকট দূর করতে উপযোগি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোঃ তোফাজ্জল ইসলাম। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়ের বেশ কিছু দিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। জানিয়েছেন বিপর্যয় মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কেও।
ড. ইসলাম জানান, ‘ বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কৃষি জমি প্রতিনিয়ত কমছে। যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠিকে বাঁচিয়ে রাখাটাই রীতিমত চ্যালেঞ্জ, তখন জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়ের ইস্যুটি নতুন ভাবে , নতুন সংকট নিয়ে যোগ হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের আবহাওয়া ক্রমশ: পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সে রকম কোন কোয়ান্টেটিভ ডাটা এখনো নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্বেও হয়েছে। তাই এই পরিবর্তন নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা ঠিক নয়। আমাদের দেশ ভৌগোলিকভাবেই দুর্যোগপ্রবণ। বিগত কয়েক শতাব্দীর চেয়ে এটাই ভাল সময় বলা যায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তন বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রয়োজন সুদূরপ্রসারি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
ড. তোফাজ্জল ইসলামের মতে, পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জ্ঞান। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে লবণাক্ত বা জলমগ্ন কৃষিভূমিতে খাদ্য উৎপাদনে গতানুগতিক অভিযোজন কৌশল যথেষ্ট নয়। কারণ অভিযোজন প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বিকল্প পন্থা অবলম্বন করতে হবে। বায়োটেকনোলজি ও জিন প্রকৌশল হচ্ছে সময়োপযোগী বিকল্প উৎকৃষ্ট পন্থা। বর্তমান সরকার এবিষয়ে সচেতন, তবে এসকল প্রযুক্তি কাজে লাগানোর সংস্কৃতি এখনো গড়ে উঠেনি। এখনো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবনাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকা অনেক উদ্ভিদ রয়েছে, যা থেকে জিন নিয়ে বৈরি পরিবেশ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। তাছড়া গতানুগতিক কৃষি গবেষণায় চলমান এসব সংকট নিরসনে খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করি না।
বাংলাদেশে জন্ম নেয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন’ ‘ এধরণের উচ্চমানের বিজ্ঞানী আমাদের দেশ থেকে ব্রেইন ড্রেইন হয়ে যাচ্ছে, তাদের ব্রেইন গেইন করতে হবে। যাদের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতিশীল ও সময়োপযোগী উদ্ভাবন সম্ভব হবে। ’ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল প্রাপ্তি প্রসঙ্গে ড. ইসলাম আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক তহবিল প্রাপ্তির জন্য দেশের দুর্নীতিমুক্ত ইমেজ খুবই জরুরি।
কৃষি বাংলাদেশের প্রধানতম খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগেরও বেশি মানুষ এখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষি পেশার সাথে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়ের ফলে সবচে’ বেশি ক্ষতির মূখে পড়বে দেশের কৃষি খাত। কৃষিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অন্যান্য খাতের সংকট মোকাবেলায় নেয়া সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে নেয়া পদক্ষেপগুলো বহুলাংশেই বিচ্ছিন্ন ভাবে হচ্ছে। তাই এসব পদক্ষেপ গ্রহণে দরকার সুসমন্বয়ের। বাংলাদেশের জলবায়ু বিপর্যয় ও করণীয় সম্পর্কে এমন অভিমত কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের।
শাইখ সিরাজ মনে করেন, ‘সংকট কেবল শুরু। জলবায়ু বিপর্যয়ের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। তখন থেকেই যদি এবিষয়ে চিন্তা করা হতো, কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে আজকে এমন হতো না। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় জীবন ব্যবস্থা কে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। সেখানে ক্ষারত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে, গবেষকরা ভিশন বুঝে উঠতে পারছেন না। অথচ উপকূলীয় এলাকার অনেক কৃষকের সাথে কথা বলে জেনেছি, সেখানে ২৫/৩০ ক্ষারত্ব সহনশীল জাত ছিল, যার সাথে ক্রস করে অধিক লবনাক্ত সহিষ্ণু জাত বের করা সম্ভব হতো। ফিলিপাইন, ভিয়েতনামের মতো অনেক লবনাক্ত প্রবণ দেশ রয়েছে। সেসব দেশেও বিরূপ পরিবেশ উপযোগী চাষাবাদ হয়। আমাদের উপকূলে প্রয়োজনে সেখানে লবণসহিষ্ণু চাষাবাদের পাশিপাশি ভেটকি মাছের মতো লবণসহিষ্ণু মাছ চাষ করবো। ফিলিপাইনে বহু মানুষ পানির উপর ঘর বানিয়ে ভাসমান জীবন যাপন করে। প্রয়োজনে আমাদের সে রকম অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ’
শাইখ সিরাজ আরো মনে করেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সংকট মোকবেলায় বিক্ষিপ্ত ভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর স্থায়ী সমাধান না করে কিছু ত্রাণ দিয়ে তাদের অথর্ব বানানো হয়েছে। তাই সমস্যাগুলো সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৯ ঘণ্টা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১