ফিফা ডট কম’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওয়ার্ল্ডকাপ মোমেন্টস প্রকাশ করেন ৩০ অক্টোবর ৫৭-তে পা রাখা ম্যারাডোনা। এর মধ্যে রয়েছে ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের আসরে নিজের প্রথম গোল, প্রথম ও একমাত্র লাল কার্ড, গোল অব দ্য সেঞ্চুরি এবং ম্যারাডোনা ম্যাজিকের উল্লেযোগ্য কিছু।
১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপ
আর্জেন্টিনা ৪-১ হাঙ্গেরি: প্রথম ওয়ার্ল্ডকাপ গোল
সতীর্থের জোরালো শট গোলরক্ষক ফিরিয়ে দেন। ডিফেন্ডারের চ্যালেঞ্জের মধ্যে দৌড়ে এসে নিচু হেডে বল জালে পাঠান ম্যারাডোনা। বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ মুহূর্তগুলোর মধ্যে এটিই বলেন প্রথমে, ‘আমি শুধু বল জালে নিতে চেয়েছিলাম, অন্য কিছুই নয়। আমরা বেলজিয়ামের কাছে প্রথম ম্যাচ (গ্রুপ পর্ব) হেরেছিলাম এবং সবার লক্ষ্য ছিল ঘুরে দাঁড়ানো। আমি অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের গোল করেছি কিন্তু আপনি এই অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন না যখন ওয়ার্ল্ডকাপে স্কোর করবেন। এটা দেখতে এমন ছিল আপনার মা বেডে এসে আপনাকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। এটা খাঁটি সুখ, অনেকটা যখন আমি আমার মাকে চুমু দিতাম। তখন অনেক কিছুই আমার মাথায় কাজ করছিল। ’
১৮৮২ স্পেন বিশ্বকাপ
আর্জেন্টিনা ১-৩ ব্রাজিল: বাতিস্তাকে কিক মেরে লাল কার্ড
ম্যাচটি ছিল দ্বিতীয় রাউন্ডের। সতীর্থ বল নিতে গেলে পেছন থেকে এসে পা দিয়ে কেড়ে নিয়ে সামনে এগোতেই ব্রাজিলের বাতিস্তার তলপেটে লাথি মেরে সরাসরি লাল কার্ড দেখেন। এই ঘটনা ভুলতে পারেননি ম্যারাডোনা, ‘আমি এক বছর পর বাতিস্তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম এবং ফ্যালকাওয়ের সঙ্গেও। ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে তারা আমাদের সাথে মজা করছিল। অামি সামান্যও হারতে পছন্দ করি না। সে আমাকে বলেছে, ‘না, ডিয়েগো। এটা শুধুই ফুটবল যা আমরা মাঠেই অনুভব করেছি। ’
‘কিন্তু আপনি কি জানেন? যদি আমি তিন গোলে এগিয়ে থাকতাম এবং ‘ওলে! ওলে! ওলে!’ বলে গান শুরু করতাম যখন আমরা চারদিকে বলের জন্য ছুটছি, তখন আপনি কিছুটা পাগলাটেও হয়ে যাবেন। যদি আপনার শিরার মধ্যে এতটুটু রক্ত থাকে, আপনি রাগে জ্বলে উঠবেন। কিন্তু হ্যাঁ, আমি ভুল খেলোয়াড়কে কিক মেরেছিলাম। অবিশ্বাস্য!’-যোগ করেন ম্যারাডোনা।
দেখে নিন ম্যারাডোনার চোখে তার সেরা পাঁচটি বিশ্বকাপ মুহূর্ত:
১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ
আর্জেন্টিনা ২-১ ইংল্যান্ড: গোল অব দ্য সেঞ্চুরি
ঐতিহাসিক কোয়ার্টার ফাইনালে হাত দিয়ে গোলের (দ্য হ্যান্ড অব গড) ৪ মিনিট পরই শতাব্দির সেরা গোলের (দ্য গোল অব দ্য সেঞ্চুরি) জন্ম দেন ম্যারাডোনা। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় এটি তার সেরা বিশ্বকাপ মুহূর্ত হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ম্যারাডোনার প্রতিক্রিয়া, ‘আমি কখনোই এরকম গোলস্কোর করিনি। আমি আরও কিছু গোল করেছি যেগুলোকে দূরে রাখাটা কঠিন, কিন্তু এটা ছিল বিশ্বকাপে। এটা প্রত্যেক শিশুর ড্রিম। আমরা সবাই ড্রিবলিং করে অনেককে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি, পিটার শিল্টনও (কিংবদন্তি ইংলিশ গোলরক্ষক) এর মধ্যে। আমি এখনো বুঝতে পারছি না সে এটি কী করেছিল। কোনো অপার্থিব শক্তি এসে তাকে সরিয়ে নিয়েছে কিনা অামি জানি না। সে শুধু আমার জন্য গোলের মুখটা বড় করে দিয়েছে। আমি শুধু তাকে অতিক্রম করেছি এবং তা এটাই ছিল! (গোল অব দ্য সেঞ্চুরি)। ’
‘আমি কখনোই এটি দেখে ক্লান্ত হই না। যেমনটা আমার মা আমাকে এ কথাটাই বলে অভ্যস্ত যখনই আমি তাকে টিভিতে এই গোলটি দেখতে দেখি। ‘কাম অন, মাম! এই গোলটি আবারো দেখছো!’ এবং সে আমাকে বলে যে ছেলের এই গোলটি দেখলে তার মধ্যে সম্পূর্ণ আরামদায়ক অনুভূতি কাজ করে। ‘তুমি যাও যদি তুমি চাও। আমি তোমার গোলটি দেখা অব্যাহত রাখছি। ’-যোগ করেন ৮৬’র বিশ্বকাপ জয়ী।
ফিফা ক্লাসিক প্লেয়ার দিয়েগো ম্যারাডোনা। এই ভিডিওটিও দেখে নেওয়া যাক...
১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপ
আর্জেন্টিনা ১-০ ব্রাজিল: ক্লদিও ক্যানিজিয়াকে জাদুকরি অ্যাসিস্ট
প্রতিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড়ের চ্যালেঞ্জর মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত অসাধারণ পাস দিয়ে ম্যাচের শেষদিকে জয়সূচক গোল করান ম্যারাডোনা। গোলরক্ষককে কাটিয়ে ফিনিশিং টানেন ক্যানিজিয়া। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে ১-০ গোলে হেরে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল। প্রসঙ্গত, ফাইনালে শেষদিকের পেনাল্টি গোলে আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গ করে প্রতিশোধ নেয় আগেরবারের রানার্সআপ তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি। টানা দু’বার বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারেননি ম্যারাডোনা।
ব্রাজিলের বিপক্ষে গোলের অ্যাসিস্টটি স্মরণ করছেন ম্যারাডোনা, ‘ব্রাজিলিয়ানরা এই গোলটির জন্য অ্যালেমাওকে দোষারোপ করে, কিন্তু আমি তাকে দ্রুতই ছাড়িয়ে যাই। সে আমাকে আসলেই চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং আমি আমার কনুই ব্যবহার করে তাকে থামিয়েছি, আমার দিকে ছিল দুঙ্গা। তাই এটা অ্যালেমাওয়ের ভুল নয়, দুঙ্গার। সে আমাকে তাকে পেছনে ফেলতে সুযোগ করে দিয়েছে। ’
ম্যারাডোনা আরও যোগ করেন, ‘যখন কানি (ক্যানিজিয়া) গোল করলো, আমি ঈশ্বর, আমার মা ও ওয়ার্ল্ডের সব সন্ন্যাসীদের ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। সে খুব কমই উদযাপন করে। সে শুধু মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে ধরেছিল। যেন কিছুই হয়নি। যখন তাকে পরে দেখি, তাকে বলি, ‘শুনো, এখানে দিনের ঠান্ডা আলোয় তুমি কি দেখেছো তুমি কী করেছো? সে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি একটি গোল করেছি। ’ ‘না, তুমি তা করোনি! তুমি পুরো স্টেডিয়ামের নীরবতা হ্রাস করেছো!’
এই ম্যাচ শেষে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন ম্যারাডোনা, ‘ব্রাজিলিয়ানদের প্রতি সম্মান রেখে, ড্রেসিংরুমে ফেরার সময় ব্রাজিলের জার্সি পরেছিলাম। এটা ছিল কারেকার। সে আমার বন্ধু। কিন্তু আমার অনুভূতি এমন ছিল…এমন না যে আমরা ব্রাজিলকে ছিনতাই করেছি কিন্তু তারা আর্জেন্টিনার পরিবর্তে সামনের ধাপে যাওয়ার দাবিদার ছিল। তারা পুরো ম্যাচ জুড়েই আমাদের চাপে রেখেছিল কিন্তু আমরা জিতেছি। এ কারণেই ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর খেলা। ’
৩১ বছর আগে ম্যারাডোনার ৮৬’র মাস্টারপিসের প্রতিফলন তারকাদের কথায়। দেখুন ভিডিওতে...
১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপ
ইতালি ১-১ আর্জেন্টিনা (৪-৩ ব্যবধানে পেনাল্টি জিতে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা): স্পট কিকে জেঙ্গাকে পরাস্ত করা
‘এটা ছিল অনেকটা বিস্ময়কর যখন আমরা পেনাল্টিতে গিয়েছিলাম, মাঠে ইতালিয়ানরা আমাকে বলে তাদের ম্যাচটি জেতা উচিৎ ছিল। লুইগি ডি অগোস্তিনি ও ওয়াল্টার জেঙ্গা আমাকে বলেছিল ড্রও নাকি ন্যায্য ফলাফল ছিল না। কিন্তু এরকম একটি ম্যাচে এমন প্রশ্ন প্রত্যাশিত নয়, তাই কি? তাদের কাছে তাদের মতামত এবং আমার কাছে আমারটা!’
‘অামি মাত্রই যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করেছিলাম। তাই যখন আমি আমার শটটি (উইনিং শট) নিতে মাঝমাঠ থেকে হাঁটা শুরু করি আমি নিজেকে বলি, ‘যদি তুমি এটি মিস করো, তুমি একটা ইডিয়ট। যদি তুমি মিস করো, তুমি একটা গাধা, তুমিই সবচেয়ে খারাপ। তুমি সব মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারো না যারা তোমাকে ভালোবাসে-মা, বাবা, আমার ভাইয়েরা, আর্জেন্টিনার জনগণ, সবাই! কিন্তু পরে আমি জেঙ্গার চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিলাম এবং তাকে পরাস্ত করেছি এবং অামরা ফাইনালে গিয়েছিলাম। এটা ছিলাম আমি যে ইতালিয়ানদের টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করেছে। ’-যোগ করেন তর্কসাপেক্ষে ‘সর্বকালের সেরা’ দিয়েগো ম্যারাডোনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৯ ঘণ্টা, ৩১ অক্টোবর, ২০১৭
এমআরএম