ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

কাতার বিশ্বকাপ: ঝলমলে আলোর নিচেই ঘুটঘুটে অন্ধকার

মোয়াজ্জেম হোসেন মানিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০২২
কাতার বিশ্বকাপ: ঝলমলে আলোর নিচেই ঘুটঘুটে অন্ধকার

কাতার বিশ্বকাপকে ঘিরে তর্ক-বিতর্কের যেন শেষ নেই। আয়োজক দেশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ দেশটির নাম ঘোষণার পর থেকেই নিত্যনতুন বিতর্ক দানা বাঁধতে থাকে।

এবার মূল আসর শুরু হওয়ার মাত্র মাস তিনেক আগে উঠলো গুরুতর অভিযোগ।  

আয়োজক হতে কাতারের বিরুদ্ধে ফিফাকে ঘুষ প্রদান থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ উপলক্ষে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এরপর সামনে আসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা। জানা যায়, বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম বানানোর কাজ করতে গিয়ে ১০ বছরে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর অভিযোগও আছে। কিন্তু এবারের অভিযোগটি উঠলো একদম শেষ সময়ে।

এ বছরের নভেম্বরে কাতারে বসবে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের আসর। এ উপলক্ষে দেশটিতে ভিড় করবেন হাজারো দর্শক-সমর্থক থেকে শুরু করে খেলোয়াড়, ফিফা কর্মকর্তা ও লাখো পর্যটক। তাদের আরাম-আয়েশের জন্য বেশকিছু বিলাসবহুল হোটেল তৈরি করে রাখা হয়েছে। হোটেলগুলো আবার ফিফা কর্তৃক অনুমোদিত। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, এসব হোটেলের কর্মীদের ঠিকভাবে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশ, নেপাল, কেনিয়ার মতো দেশ থেকে যে শ্রমিকরা সেখানে কাজ করছেন, তাদের পারিশ্রমিক অন্যদের চেয়েও কম।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম 'ডেইলি মেইল' জানিয়েছে, মানবাধিকার গ্রুপ 'একুইডেম' তদন্ত করে বিশ্বকাপ হোটেলগুলোতে কর্মীদের কম পারিশ্রমিক দেওয়ার তথ্য পেয়েছে। কাতারের ফিফা অনুমোদিত ২৯টি হোটেলের ৬৯ জন কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে তারা। ওই হোটেলকর্মীদের অভিযোগ, প্রতি ঘণ্টায় তাদের মাত্র ১ পাউন্ড (প্রায় ১১৬ টাকা) পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। তারা জানিয়েছে, হোটেলগুলো নাকি ওভারটাইমের জন্য বাড়তি অর্থ দিচ্ছে না। কয়েকজনের অভিযোগ, জাতীয়তার কারণে তাদের ভিন্ন চোখে দেখা হচ্ছে।  

'ডেইলি মেইল' জানিয়েছে, ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনে সবমিলিয়ে প্রায় ১৩৮ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ হবে। আর আসর থেকে তাদের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৩ বিলিয়ন পাউন্ড। পুরো আয়োজনের জন্য কাতারজুড়ে বহু স্থাপনা নির্মাণ করতে হয়েছে। এর মধ্যে বিলাসবহুল হোটেলও আছে বেশ কয়েকটি। এসব হোটেলে এক রাত কাটানোর খরচ হবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা) পর্যন্ত। ৩২ দলের ৮০০-এর বেশি খেলোয়াড় বিশ্বকাপে অংশ নেবে। এর মধ্যে এমন অনেক খেলোয়াড় আছেন যাদের দুই মিনিটের আয় হোটেলকর্মীদের পুরো মাসের আয়ের সমান।

ব্রাজিলের নেইমার জুনিয়র সপ্তাহে আয় করেন ৬ লাখ পাউন্ড (প্রায় ৭ কোটি টাকা)। তার পিএসজি সতীর্থ ও ফরাসি ফরোয়ার্ড কিলিয়ান এমবাপ্পে সপ্তাহে আয় করেন ১ মিলিয়ন পাউন্ড (সাড়ে ১১ কোটি টাকার বেশি)। এমন কোটি কোটি অর্থ আয় করা খেলোয়াড়দের মিলনমেলা বসবে কাতার বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে কোটিপতি পর্যটকরাও ভিড় করবেন হোটেলগুলোতে। তাদের বিলাসিতার যোগান দিতে প্রায় ২০ লাখ প্রবাসী শ্রমিক দিনে প্রায় ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পরিশ্রম করছেন; বিনিময়ে তাদের দেওয়া হচ্ছে নামমাত্র পারিশ্রমিক।

কাতারের বিশ্বকাপ ভেন্যুগুলোতে শ্রমিকদের ওপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে ৬৫ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে 'একুইডেম'। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, হোটেলগুলোর কর্মীরা দিনে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন। এমনকি কোনো কোনো মাসে তাদের ছুটির দিনও বাতিল করা হয়। দিনে ৯ ঘণ্টা কাজ করানো হয়; বিনিময়ে তাদের ঘণ্টায় দেওয়া হয় মাত্র ১ পাউন্ড করে। কিন্তু ওভারটাইমের জন্য বাড়তি অর্থ না দেওয়ায় তাদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ ঘণ্টাপিছু আরও কম। অনেককে ঠিকমতো বেতন দেওয়া হচ্ছে না। অথচ দালালদের মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়া হচ্ছে, যাতে শ্রমিক সঙ্কট না হয়। যদিও তা কাতারে বেআইনি।

'একুইডেম' তাদের রিপোর্টে দাবি করেছে, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়ার মতো দেশগুলোর প্রবাসী শ্রমিকদের বাকিদের চেয়ে কম পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে। তুলনায় আরব শ্রমিকরা বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। এসব সমস্যার কথা প্রকাশ করলে তাদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি চাকরি পাল্টানোর চেষ্টা করলে তাদের পারিশ্রমিক আটকে দেওয়া হচ্ছে।  

ওই রিপোর্টে দোহার ওয়েস্টিন হোটেলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই হোটেলে ব্রাজিল দল বিশ্বকাপের সময় অবস্থান করবে। হোটেলের এক নেপালি কর্মী জানিয়েছেন, সেখানে কাজ করে মাসে তিনি এক হাজার কাতারি রিয়াল (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৬ হাজার টাকা) পারিশ্রমিক পান। বোনাস হিসেবে পান ৩০০ কাতারি রিয়াল। গত বছর পাশ করা নতুন আইন অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে একজন শ্রমিকের সর্বনিম্ন পারিশ্রমিক মাসে এক হাজার কাতারি রিয়াল। সেই সঙ্গে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব চাকরিদাতার। কিন্তু এই ব্যবস্থা না করলে খাওয়ার জন্য ৫০০ কাতারি রিয়াল এবং থাকার জন্য ৩০০ কাতারি রিয়াল দেওয়ার কথা।  

'স্পোর্টসমেইল'-কে দোহার ওয়েস্টিন হোটেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখন তারা প্রতি মাসে কর্মীদের ১৫০০ কাতারি রিয়াল পারিশ্রমিক দিচ্ছে। তবে এই পরিমাণ অর্থ সব কর্মীদের দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে এক হোটেলের কর্মী জানিয়েছেন, চাকরিদাতার পক্ষ থেকে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ছোট্ট এক রুমে পাঁচজন লোক গাদাগাদি করে থাকেন তারা। ওই রুমেই নিজেদের খাটের নিচে তাদের খাবার রাখা এবং রান্নার সরঞ্জাম রাখতে হয়। ফলে বিভিন্ন পোকামাকড়ে অত্যাচারে রুমে থাকাই দায় হয়ে পড়ে।  

তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এটাও স্বীকার করেছে, ধীরে ধীরে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ঠিক হচ্ছে। কাতারি সরকার এরইমধ্যে প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং চাকরিদাতাদের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, এসব ব্যবস্থা মোটেও যথেষ্ট নয়। এখনও হাজারো শ্রমিক দুর্বিষহ সময় পার করছে সেখানে। কাজের চাপে বিশ্রাম তো দূরের কথা, অনেকে ঘুমের সময়টাও পাচ্ছেন না। অনেকটা রোবটের মতো কাজ করতে হয় বলে অভিযোগ এক ভারতীয় হোটেলকর্মীর। এমনকি তাদের সময়ের হিসাব রাখার ক্ষেত্রেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। অফিসে ঢোকার সময় ও বের হওয়ার সময়ের হিসাব রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, চাকরি পাওয়ার জন্যও অনেক অর্থ খরচ করতে হয় প্রবাসী শ্রমিকদের। যদিও এই অর্থ পরিশোধ করার কথা চাকরিদাতার। মানবাধিকার কর্মীদের বাংলাদেশি শ্রমিকরা জানিয়েছেন, দালালদের পেছনে তাদের খরচ করতে হয় জনপ্রতি এক হাজার পাউন্ডের (প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা) বেশি। তাদের অনেকে জানেন না যে, এই অর্থ পরিশোধ করার কথা চাকরিদাতার। বিষয়টি চাকরিদাতাদের পক্ষ থেকে গোপন রাখা হয়। ফলে অনেক স্বপ্ন নিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার আগেই মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ হয়ে যায় তাদের; যেজন্য অনেকে আবার ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েন। আবার চাকরিতে যোগ দিয়ে সেই অর্থ তুলতে গিয়ে নানান নির্যাতন সইতে হয় তাদের; করতে হয় অমানুষিক পরিশ্রম। কিন্তু পরিবার এবং নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা এসব কথা গোপন করেন এবং চোখের জল মুছে কাজ চালিয়ে যান; যেন মাসশেষে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০২২
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।