ঢাকা, শুক্রবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩২, ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৮ মহররম ১৪৪৭

স্বাস্থ্য

শিশুর দেরিতে কথা বলার পেছনে স্ক্রিনটাইমের প্রভাব

মো: রতন উদ্দিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৫৬, জুলাই ৪, ২০২৫
শিশুর দেরিতে কথা বলার পেছনে স্ক্রিনটাইমের প্রভাব

বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের ব্যস্ত জীবন পুরোটাই প্রযুক্তি নির্ভর। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি যেমন জীবনকে সহজ ও গতিশীল করেছে তেমনি প্রযুক্তিনির্ভরতার কিছু নেতিবাচক দিকও  আছে।

মানুষের জীবনে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি শিশুর ভাষাগত বিকাশের জন্য সঠিক পরিবেশ, খেলাধুলা ও মানুষের সাথে সামাজিক যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণা বলছে, মোবাইল, টিভি ও ট্যাব ব্যবহারের ফলে শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক রয়েছে। সাউথ আফ্রিকান জার্নাল অফ কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডারস এ ‘শিশুদের ভাষা বিকাশে স্ক্রিন টাইমের প্রভাব, একটি পরিকল্পিত পর্যালোচনা’ নামক প্রবন্ধে ১২টি প্রবন্ধের ফলাফল যাচাই করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ভাষা শেখার প্রারম্ভিক দিকে স্ক্রিনটাইম শিশুর ভাষা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, একইভাবে তুলনামূলক বড় শিশুদের ক্ষেত্রে স্ক্রিনটাইম ক্ষেত্রবিশেষে বুদ্ধিগত ও যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

কানাডায় অসুস্থ শিশুদের জন্য হাসপাতাল-এর পরিচালিত এক গবেষণায় গবেষক ড.ক্যাথেরিন বার্কেন এর মতে, কোন শিশু যদি দিনে ৩০ মিনিট মোবাইল কিংবা স্ক্রিনে সময় কাটায় সেক্ষেত্রে সেই শিশুর স্পিস ডিলে হবার সম্ভবনা প্রায় ৪৯% বেড়ে যায়।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস (এএপি) সদস্য মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ড. জেনি রাডেস্কির ভাষ্যমতে, সাধারণত শিশুরা (শিশু এবং ছোট বাচ্চারা) স্ক্রিনে প্রদর্শিত কন্টেন্টের সাথে বাস্তব জীবনের মিল করতে পারে না। শিশু এবং ছোট বাচ্চারাদের এত চিন্তাশক্তি কিংবা কল্পনা করার দক্ষতা থাকে না। এমনকি ভিডিও দেখে সেসব অনুকরণ করে সেগুলো বাস্তব জীবনে ব্যবহার করতে পারে না।

ড. জেনি রাডেস্কি আরো শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, শিশুরা স্ক্রিনে থাকা সময়গুলোতে মানবিক যোগাযোগ থেকে থেকে বিরত থাকে। যা শিশুদের ভাষা বিকাশের অন্তরায় হতে পারে। এমনকি কিছু প্রাক-প্রাথমিক যোগাযোগ দক্ষতা যেমন- চোখে চোখ রাখা এবং মনোযোগ দক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

নিউইয়র্কে হান্টার কলেজের স্পিস ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজি এন্ড অডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট ম্যাকরয় হিগিন্স তাদের প্রকাশিত বই ‘টাইম টু টক" এ বলেছেন যে, যেহেতু স্ক্রিন টাইম শিশু এবং ছোট বাচ্চারাদের পিতামাতা, কেয়ারটেকার কিংবা যোগাযোগ সঙ্গী থেকে দূরে রাখে, সেক্ষেত্রে শিশুর ভাষা বিকাশজনিত সময় বিলম্বিত হতে পারে।

এরকম আরো কিছু আর্টিক্যাল আছে, যেখানে ১৮ মাস কিংবা ২ বছরের পূর্বে স্ক্রিনের ব্যবহার শিশুর কথা বলার দক্ষতা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।

তবে বেশিরভাগ গবেষক এই বিষয় নিয়ে আরো গবেষণা হতে পারে বলে মতামত প্রকাশ করেছেন।

স্বাভাবিক বিকাশ  অনুসারে, ১২-১৫ মাস বয়সী শিশুর  বোধগম্য শব্দভাণ্ডার থাকবে প্রায় ৫০টি এবং প্রকাশগত শব্দভাণ্ডার থাকবে প্রায় ১০টি, যেটা দুই বছর বয়সে ২০০ বোধগম্য ভাষা এবং ৫০টি প্রকাশজনিত ভাষা  মিলে শব্দভাণ্ডার গঠিত হয়।

এক দশকের অধিক সময়ব্যাপী স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করে আমার এই বিষয়টি উপলব্ধ যে, শিশুদের মোবাইল, টিভি কিংবা স্ক্রিন টাইম ব্যবহারের ফলে বোঝার দক্ষতা কিছুটা বাড়লেও বলার দক্ষতা বিলম্বিত হতে পারে।
 
আমরা অনেকেই অটিজমের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত মোবাইলের ব্যবহারকে দায়ী করে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।  তবে কিছু গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার অটিজম আক্রান্ত বাচ্চার অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলোর তীব্রতা বাড়াতে পারে। যদিও পেশাজীবনে আমি অনেক অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুকে স্মার্টফোন, টিভি ও ট্যাব ব্যাবহারে মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে দেখেছি, পাবলিক প্লেসে শান্ত থাকে এবং সামজিক ও যোগাযোগ দক্ষতা  অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।  

আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়েট্রিক্স, স্ক্রিন ব্যাবহারে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে, যা হল

১। শূন্য-আঠার মাস কোন স্ক্রিনটাইম দেয়া যাবে না। সর্বোচ্চ কিছু সময়ের জন্যে পরিবারের মানুষের সাথে ভিডিও চ্যাট হতে পারে। যেমন: আপনি বাচ্চাকে রেখে অফিসে আসছেন, মাঝখানে অল্প সময়ের জন্যে বাচ্চার সাথে ভিডিও চ্যাট  করলেন।

২। ১৮-২৫ মাস সময়ে সীমিত আকারে স্ক্রিনটাইম দেয়া যেতে পারে। বড়রা সংযুক্ত থেকে শিক্ষণীয় প্রোগ্রাম দেখতে পারে। সেক্ষেত্রে পরোক্ষ ভিডিওর চেয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক এপস কিংবা ডিজিটাল মিডিয়া দিতে পারেন।

৩। ২-৫ বছর, এই বয়সে ডিভাইস থেকে বিরত রাখা বাস্তবিক কোন সিদ্ধান্ত নয়। পৃথিবী প্রতিনিয়ত ডিজিটাল হচ্ছে। চেষ্টা করুন বাচ্চাকে সর্বোচ্চ শিক্ষণীয় প্রোগ্রাম দেখাতে কিংবা অংশগ্রহণ করাতে। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন সর্বোচ্চ একঘণ্টা ডিভাইস দিতে পারেন। ছুটির দিনগুলোতে সময়টা আরেকটু বেশি হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ১৮ মাসের আগে কোনো প্রকার স্ক্রিন টাইম (টিভি, মোবাইল, ট্যাব  ইত্যাদি) দেয়া যাবে না। এই সময়গুলোতে শিশুর সাথে প্রচুর খেলাধুলা করুন, হাসুন, চোখে চোখ রেখে কথা বলুন, অনুকরণ জনিত খেলা খেলুন, ছড়া বলুন। এমনকি শিশু খেলছে, পাশে কেউ ফোন টিপছে কিংবা ঘরে টিভি চলছে, এইগুলো থেকেও বিরত থাকুন। ১৮ মাসের পর থেকে কিছু নিয়ম কানুন মেনে স্ক্রিন টাইম উপভোগ করা যেতে পারে।

লেখক: স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।