ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ): চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন।
এখানে রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয় চিকিৎসকদের পছন্দমতো একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
একই রোগে আক্রান্ত উপজেলার ভালুকজান থেকে আসা রেহেনা আক্তারকেও (৩০) পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় একটি বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে। ক্ষোভ ঝেড়ে রেহেনা বলেন, নামেই সরকারি হাসপাতাল। সব পরীক্ষা বাইরে থেকেই করতে হয়।
শুধু দেলোয়ার কিংবা রেহেনা নন, এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা বেশিরভাগ রোগীর অভিযোগ অভিন্ন। নানা অযুহাতে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য নিজেদের পছন্দমতো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের পাঠান এখানকার চিকিৎসকরা।

এ হাসপাতালের ল্যাবরেটরি বিভাগে রক্ত, ইউরিনসহ বিভিন্ন পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাদের বাইরের ওইসব প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। আর প্রতিটি পরীক্ষার জন্য এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কমিশন পান চিকিৎসকরা।
সম্প্রতি সরেজমিনে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঘণ্টা পাঁচেক অবস্থান করে অনিয়ম ও ভোগান্তির এমন খণ্ড খণ্ড চিত্রের দেখা মেলে। তবে এ চিত্র নিত্যদিনের বলে অভিযোগ করেন বিভিন্ন প্রত্যন্ত পল্লী থেকে আসা রোগীরা।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্ট মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন রোগী এখানে পরীক্ষা করেন।
রোগীর সংখ্যা এতো কম কেন, প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে তিনি নীরব থাকেন। চিকিৎসকরা কী রোগীদের বাইরে পাঠিয়ে দেন, জিজ্ঞাসা করতেই মুচকি হাসেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আতাউল জলিল বাংলানিউজকে বলেন, আমি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন পরীক্ষার রেট ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা বেশিরভাগ রোগীর অভিযোগ, ঘড়ির কাঁটা দুপুর ১২ টার ঘরে পৌঁছুতেই ল্যাবরেটরি বন্ধ।

এই বন্ধ ল্যাবরেটরির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা মিয়া। সদর উপজেলার দাপুনিয়া এলাকা থেকে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি এসেছিলেন এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে।
সংশ্লিষ্ট মেডিকেল অফিসার ফকরুল আলম ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেও ল্যাবরেটরিত গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করাতে পারেননি তিনি। তারা মিয়ার কথায়-পরীক্ষা করাইবার গেছিলাম। তারা কয় টাইম শেষ। দুইদিন পর যাইতে কইছে। অহন তো বাইরে থেইক্যাই পরীক্ষা করাইতে অইবো।
কেন এ নিয়ম, জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: আতাউল জলিল বাংলানিউজকে জানান, আরো বেশি সময় পর্যন্ত যাতে পরীক্ষা করা যায় সেই পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এদিকে প্রায় ৫ বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে লাখ লাখ টাকা মূল্যের একটি এক্সরে মেশিন। এটি অকেজো হয়ে থাকায় বাধ্য হয়েই রোগীদের ছুটতে হচ্ছে বিভিন্ন কিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
আর এ কারণে নিত্যদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফার) জুলফিকার আলী।
২০১২ সালে তিনি এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেন। এসেই দেখেন এক্সরে কক্ষ তালাবদ্ধ। মেশিনও নষ্ট। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে এক্সরে মেশিন নষ্ট।

অকেজো এ মেশিনটি কবে নাগাদ সচল হতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: আতাউল জলিল বাংলানিউজকে জানান, ঢাকার মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ অনুযায়ী আগে নতুন এক্সরে মেশিন স্থানান্তর করা হবে। এরপর সচলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রবেশের সড়কের দু’পাশেই ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জঞ্জাল। ছোটখাটো দোকানঘরের মতো এসব কথিত স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দালাল নির্ভর এসব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে আবার শোভা পাচ্ছে খোদ এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বশীল চিকিৎসকের নাম।
নিজের বাড়ির সামনেই চিকিৎসকদের এমন বাণিজ্য সম্পর্কে হাসপাতাল রোডের বাসিন্দা গোলাম মাওলা (৫০) বলেন, সরকারি হাসপাতালে এখন সেবা জোটে না। ডাক্তাররা বাইরে সেবা দেয় টাকার বিনিময়ে। এসব দেখারও কেউ নেই।

সেবার মান, অনিয়ম, ভোগান্তির বাইরেও এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দু:খগাঁথা নিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই স্থানীয় বাসিন্দাদের। সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১১ সালের ২ আগস্ট ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নতুন ভবন উদ্বোধন করা হয়।
কিন্তু এখনো কার্যক্রম চলছে সেই ৩১ শয্যারই। নতুন ভবনে রোগীদের শয্যার ব্যবস্থা থাকলেও নেই চিকিৎসক-সেবিকাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা।
ফলে ৩১ শয্যার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে উপজেলার প্রায় ৫ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রধান আশ্রয়স্থল এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। পুরাতন ভবনের শয্যাগুলোর অবস্থাও নাজুক।
এ বিষয়ে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আতাউল জলিল বাংলানিউজকে জানান, মাস দুয়েক আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৬
জেডএম/