ঢাকা: আমিনা বেগম। কয়েক বছর আগেও জানতেন না কম্পিউটার কি।
‘ইনফো লেডিস’ বা তথ্য কল্যাণীরা এভাবেই সাইকেলে চড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে হাজির হচ্ছেন ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে। সরকারি সেবা গ্রহণ থেকে শুরু করে প্রিয়জনের সাথে চ্যাট করা, সবকিছুতেই সহায়তা করছেন তারা। হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে নারীরা অধিক পরিমাণে গ্রহণ করছেন এই সেবা। যে দেশের ১৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৫০ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে, সে দেশের জন্য ব্যাপারটি অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
‘ইনফো লেডিস’ বা ‘তথ্য কল্যাণী’ নামক এই প্রকল্পটির শুরু হয়েছিলো ২০০৮ সালে, বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা ডি.নেট সহ আরও কিছু সংস্থার মাধ্যমে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় প্রযুক্তিতে দক্ষ নতুন কর্মজীবী তৈরি করাই এর লক্ষ্য।
ডি. নেটের তথ্য কল্যাণী প্রকল্পের আওতায় নারীদের তিনমাস প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার ও ক্যামেরার ব্যবহার শেখানো হচ্ছে। এসব যন্ত্র এবং বাইসাইকেল কেনার জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে সংস্থাটি।
ডি.নেটের নির্বাহী পরিচালক অনন্যা রায়হান এ ব্যাপারে বলেন, “এর মাধ্যমে একদিক দিয়ে যেমন নারীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামের মানুষরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তির নাগাল পাচ্ছেন। ”
গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের স্নাতক পাশ নারীরা অবশ্য বিনামূল্যে এই সেবা ব্যবহার করছেন না। তবে কিছু নির্দিষ্ট তথ্য সেবা ছাড়া অনেক সামাজিক সেবাই বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন তথ্য কল্যাণীরা।
গাইবান্ধার বাসিন্দা আমিনা বেগমের কথাই ধরা যাক। সৌদি আরবে কর্মরত স্বামীর সাথে এক ঘণ্টা স্কাইপেতে কাটানোর জন্য তাকে ২০০ টাকা দিতে হয়। ইয়ারফোন দিয়ে স্বামীকে হাসিমুখে জানান টাকা পৌঁছানোর খবর। সংসারের নানা গল্প করেন, জমি কেনার স্বপ্ন নিয়ে আলাপ করেন স্বামীর সাথে। এমনকি আমিনার বৃদ্ধা শ্বাশুড়িও স্কাইপেতে তার ছেলের সাথে কথা বলেন।
সঘাটা গ্রামের ১৬ বছর বয়সী তামান্না ইসলাম দিপারও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম একজন তথ্য কল্যাণী।
“আমার কোন কম্পিউটার নেই, তাই আমি তথ্য কল্যাণীর ল্যাপটপ ব্যবহার করে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করি,” বলেন দিপা। ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে ক্লাসনোট নিয়ে আলাপ করার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়েও আলোচনা করেন তিনি।
এই তথ্যকল্যাণীরা কিশোরীদের সাথে প্রযুক্তি ছাড়াও নারীস্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে থাকেন। নতুন সংশোধিত তথ্যাধিকার আইনের আওতায় সকল সরকারি সেবা বুঝে নিতে উৎসাহিত করছেন তারা।
কৃষকদেরও সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার নিয়ে নানা উপদেশ দিচ্ছেন তথ্যকল্যাণীরা। মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আবেদন ফরম অনলাইনে পূরণ করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এমনকি রক্ত পরীক্ষা ও রক্তে সুগারের পরিমাণ পরীক্ষা করার প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন কেউ কেউ।
অনন্যা রায়হানের মতে, “তথ্যকল্যাণীরা একই সাথে উদ্যোক্তা এবং সেবা প্রদানকারী। ”
২০০৪ সালে ‘মোবাইল লেডিস’ নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনুস বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে নারীদের কাছে মোবাইল প্রযুক্তি পৌঁছে দিয়েছিলেন। অত্যন্ত সফল হয়েছিলো সেই উদ্যোগ, যার কল্যাণে বর্তমানে বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ২০ লাখ। সেখান থেকেই তথ্য কল্যাণী প্রকল্পের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বলে জানান অনন্যা।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের ১৯টি গ্রামে ৬০ জন তথ্য কল্যাণী কাজ করছেন। ২০১৬ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১৫ হাজারে উন্নীত করতে চান তিনি।
চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য কল্যাণী প্রকল্পের জন্য সুদবিহীন ঋণ প্রদান করতে সম্মত হয়। আগামী ডিসেম্বর মাসে প্রথম কিস্তিতে ১ কোটি টাকা দেয়ার মাধ্যমে এ ঋণদান প্রক্রিয়া শুরু হবে। অনন্যা জানান, তথ্য কল্যাণীদের সাহায্য করার জন্য প্রবাসীদেরও দেশে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করছেন তারা।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ জামিলুর রেজা চৌধুরী এই প্রকল্পের প্রশংসা করে বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মধ্যে প্রকল্পটি প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। ”
আমিনা বেগম ও দিপার এলাকার তথ্য কল্যাণী ২৯ বছর বয়সী সাথী আক্তার জানালেন, তিনি এই কাজ করে স্কুলের চাকরির চেয়ে বেশি উপার্জন করে থাকেন। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ সহ অন্যান্য খরচ মেটানোর পরও প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা জমাতে পারেন তিনি।
“আমরা শুধু উপার্জনই করছি না, পাশাপাশি নারীদের কাছে প্রযুক্তিকে পৌঁছে দিতে সহায়তা করছি। এটাই সবচেয়ে আনন্দদায়ক,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১২
আরআর