ঢাকা: প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট সাইবার জগতে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে। খুব অল্প সময়ে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হওয়ার ফলে সুফলের পাশাপাশি কুফলও বয়ে এনেছে এটি।
জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) বিশ্বব্যাপী তথ্য ও টেলিযোগাযোগ খাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আগামী ডিসেম্বর মাসে আইটিইউর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সম্মেলন বা ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ২০১২ (ডব্লিউসিআইটি-১২) তে নেয়া হতে পারে যোগাযোগ খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ইন্টারনেটের অবারিত স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধতা ও বিধি-নিষেধ আনার প্রস্তাবকে সামনে রেখে ডিসেম্বর মাসের ৩ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই সম্মেলন।
ইতোমধ্যে একে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে প্রযুক্তি বিশ্বে। এমনকি ইন্টারনেটের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা জাতিসংঘের হাতে চলে আসার সম্ভাবনাও ফেলে দিচ্ছে না আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো।
রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল, ইরান, ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো ইন্টারনেটকে শিকলে বাঁধার এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ সম্ভাবনা আরও জোরদার হয়েছে ইউরোপের সমর্থনে। ইউরোপিয়ান টেলিকমিউনিকেশন্স নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (ইটনো) সংস্থা ইন্টারনেটে সীমাবদ্ধতা ও মূল্য আরোপ করার বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে যাচ্ছে সম্মেলনে। তবে জাতিসংঘের সদস্য ১৯৪টি দেশের ভোটেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
বর্তমানে ইন্টারনেট প্রযুক্তির অঘোষিত নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, জাতিসংঘের অধীনে গেলে ইন্টারনেটের মূল বৈশিষ্ট্য সাইবার জগতে অবাধ বিচরণ বিনষ্ট হবে। এর ফলে মুক্ত অর্থনীতি ও মুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষুন্ন হবে। পাশাপাশি কিছু দেশের সরকার এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে দমন করার চেষ্টা করবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি আরব বিশ্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন উত্থান-পতনের পেছনে মূল ভূমিকা রাখে ইন্টারনেট।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের প্রযুক্তি বিষয়ক কর্মকর্তা জেমস লুইস বলেন, “ভোটে যদি সমান ফলাফল আসে তাহলে হয়তো কোন বড় পরিবর্তন হবে না। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি এই প্রস্তাবের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাহলে নাটকীয় কোন পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। ”
যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ইন্টারনেটের চালিকা শক্তি থাকা নিয়ে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসন্তোষ বিরাজ করছে, তাও স্বীকার করেন লুইস। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইন্টারনেটে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ইন্টারনেটকে বৈশ্বিক কোন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আনার পেছনে যুক্তি আছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা নিয়েও বেশিরভাগ মানুষ সন্তুষ্ট। ”
ওয়াশিংটন এই প্রস্তাবে রাশিয়া, চীনের সরাসরি বিরোধিতা করছে বলে জানিয়েছন আইটিইউতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি টেরি ক্র্যামার। তিনি বলেছেন, “ইন্টারনেটের কোন কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেই। স্বাধীনতা ও ব্যাপকতাই এর মূল শক্তি। এজন্যই কোনো সরকার বা সংস্থা কখনো এককভাবে ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ”
আইটিইউর প্রধান হামাদুন তুরে এ ব্যাপারে ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে জানিয়েছেন, সিদ্ধান্তের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপরই চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করবে।
অন্যদিকে ইউরোপিয়ান টেলিকম অপারেটরদের প্রস্তাবনায় ইন্টারনেটের আয় ও ব্যয়কে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গুগল, ফেসবুকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো ব্যবহার করার জন্য টাকা দিতে হবে, এবং এ থেকে আয়ের অংশীদার হবে সেবায় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও। এমনকি গুগল, ফেসবুককেও তাদের ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য দিতে হবে।
ইউরোপের এ প্রস্তাবে আরব দেশগুলোর জোরালো সমর্থন রয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে গুগল, ফেসবুক, ইয়াহুর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া মুনাফা অর্জন কমে যাবে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী প্রিন্ট মাধ্যমে বিজ্ঞাপনী আয় নিম্নমুখী হলেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে অনলাইন বিজ্ঞাপনের আয়, যা ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং এই বিপুল অনলাইন বিজ্ঞাপনী আয়ের ৫০ ভাগই বর্তমানে গুগলের দখলে। ইন্টারনেটে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের ফলেই সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো একচেটিয়াভাবে এই মুনাফা অর্জন করতে পারছে বলে অভিযোগ করেছে প্রস্তাবের সমর্থনকারী দেশগুলো।
আইটিইউর সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশও অংশ নেবে আসন্ন দুবাই সম্মেলনে। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত কোনদিকে গড়াবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি।
সম্মেলনে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব গৃহীত হলে প্রতিটি দেশের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সেই দেশের সরকারের কাছে ন্যস্ত হতে পারে। সরকার নিজ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করবে ও নিয়মানুযায়ী বিভিন্ন সেবা গ্রহণের জন্য মূল্য আরোপ করবে। অর্থাৎ টেলিকম খাতের মতোই সরকারি আওতায় ইন্টারনেট খাতের অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।
১৯৮৮ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একত্রিত হয়ে ইন্টারনেটের জন্য প্রাথমিক অবকাঠামো ও নীতিমালা তৈরি করে, যা আজ পর্যন্ত চলে আসছিলো। ১৪ বছর পর ইন্টারনেটের ব্যাপকতা ও প্রসারের ফলে এই নীতিমালা পরিবর্তন করার সময় এসেছে বলে আইটিইউ মনে করছে। পাশাপাশি ইন্টারনেটের ব্যাপ্তির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা সাইবার ক্রাইম, নিরাপত্তা ইস্যু, ইন্টারনেটভিত্তিক আন্দোলনকে এখনই সীমার মধ্যে টানতে না পারলে পরবর্তী সময়ে এসব সমাজে হুমকি দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছে আইটিইউ।
যেভাবে শুরু ইন্টারনেটের
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মার্কিন সেনাদের খবরাখবর তাৎক্ষণিকভাবে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু গবেষণা শুরু করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের ডামোডোলে আর প্রযুক্তির অনগ্রসরতায় সেসময় এই গবেষণা বেশিদূর এগোয়নি। তবে অমিত সম্ভাবনাময় কোনো একটা প্রযুক্তির আভাস যেন এখান থেকে পাওয়া যাচ্ছিল। তাই ৬০-এর দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণা সংস্থা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি বা আরপা জোরেসোরে গবেষণা শুরু সার্বিক এক যোগাযোগ ব্যবস্থার ধারণা নিয়ে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারের মধ্যে আরপানেট নামক একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
কে জানতো, এই ‘পরীক্ষামূলক’ যোগাযোগই একদিন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়ে বদলে দেবে পৃথিবীকে? হয়ে উঠবে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রক?
এরপর বিভিন্ন ধাপে দ্রুতগতিতে এগিয়েছে ইন্টারনেট। আলাদিনের দৈত্যের চেয়েও ক্ষমতাশালী এই প্রযুক্তির ব্যাপ্তি নিয়ে বিজ্ঞানীরা ক্রমেই আশাবাদী হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু তারপরও নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ছিলো এর গন্ডি। এরই মধ্যে আশির দশকের শেষদিকে চতুর্দিকে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য উদ্ভব হয় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের (আইএসপি), ১৯৯০ সালে বিলুপ্ত হয় গবেষণা সংস্থা আরপা। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (এনএসএফ) অধীনে পাঁচ বছর থাকার পর ১৯৯৫ সালে সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত হয় ইন্টারনেট।
এরপরের ১৫ বছর যেন গল্পের মতোই নাটকীয়। সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে উদ্ভব হলো ইলেকট্রনিক মেইল বা ই-মেইল, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, ই-কমার্স, ব্লগ ইত্যাদি। পাশাপাশি অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে চললো ইন্টারনেটের গতি, প্রভাব ফেলতে শুরু করলো মানুষের জীবন ব্যবস্থায়। ইন্টারনেটের সবচেয়ে শক্তিশালী ও একই সাথে ক্ষতিকর দিকটাও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো, যেটি হলো এর স্বাধীনতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ গানটিকে সার্থক প্রমাণ করে ইন্টারনেট মানুষের জন্য অবারিত এক দরজা খুলে দিলো। বিধি-নিষেধের বালাই না থাকার কারণেই অন্য যে কোনো প্রযুক্তির চেয়ে দ্রুত দেশে দেশে পৌঁছে গেল ইন্টারনেট।
আজও এই বিপুল ইন্টারনেট ব্যবস্থার কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক নেই। শুধুমাত্র ইন্টারনেটের কারিগরি ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক রাখার ব্যাপারটি তত্ত্বাবধান করে ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস (আইক্যান) নামক একটি বেসরকারি সংস্থা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স অ্যান্ড ইনরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন্টারনেটের নিরাপত্তার ব্যাপারটি অনেকটা তত্ত্বাবধান করে থাকে। এছাড়া ইন্টারনেট একটি সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং এর বৃহত্তম সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কিন হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকেই ইন্টারনেটের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক বললে অত্যুক্তি হয় না।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১২
আরআর; সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com