সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ব্যক্তি আক্রমণের ঘটনা অহরহই ঘটছে। কিছুদিন আগে টুইটারে এক শিশুকে হত্যা করা নিয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছে এক যুবক।
এদের সবাইকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাই বলে যে তারাই অপরাধী তা কিন্তু নয়। আবার তারা যে অপরাধী সে বিষয় নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। বিস্ময়ের কথা হচ্ছে, ব্রিটেনে প্রতিবছর গড়ে ১০০ জন মানুষ ফেসবুক, টুইটার, খুদেবার্তা, ইমেইলের মাধ্যমে আক্রমণাত্মক মন্তব্য, হুমকি এবং আপত্তিজনক ছবি পোস্ট করার আপরাধে জেলে খাটছেন।
আইনজীবীরা ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলছেন। তাদের মতে, একবিংশ শতাব্দিতে আইন নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অন্যদিকে সাধারণ জনগণ বলছেন, প্রতিটি মানুষের মুক্তমতের অধিকার আছে। ইন্টারনেট সে অধিকারকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায় মানুষের মনের কথা। সেজন্য আইন করে মুক্তমত বন্ধ করা অপরাধের সামিল।
মুক্তমত ও অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইক হ্যারি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, পঞ্চাশ বছর আগেও কারও বিরুদ্ধে কথা বলতে মানুষের একশবার ভাবতে হতো। খুব অল্প সংখ্যক মানুষের যেকোনো বিষয়ে কথা বলার সাহস ছিল।
কিন্তু বর্তমানে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। ভালো-খারাপের মিশেল হচ্ছে। যেমন শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুলকে পোড়ানো ছবি ফেসবুকে আপলোড হচ্ছে। এগুলো দেখছে হাজার হাজার মানুষ। তাদের ভেতর তৈরি হচ্ছে রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ। এ নিয়ে দুটি পক্ষ তৈরি হচ্ছে। তারা সংঘর্ষেও জরিয়ে পড়ছে।
এ নিয়ে কটি কেসস্ট্যাডি দেওয়া যেতে পারে। পল চ্যাম্বারস নামে এক ব্রিটিশ নাগরিক ২০১২ সালের জানুয়ারিতে যাবে তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু এমন সময় তুষারপাতের কারণে ফ্লাইট ধরতে পারেনি। এমন সময় সে টুইটবার্তায় জানায়, রবিনহুড এয়ারপোর্ট বন্ধ। একটি সপ্তাহ পেলাম, কিন্তু একসঙ্গে হতে না পারলে এয়ারপোর্ট আকাশে উড়িয়ে দেব।
এক সপ্তাহ পরেই পলের অফিসে পুলিশ হাজির। পল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একটানা আট ঘণ্টা নানান প্রশ্ন করা হলো। তাকে জেলে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় পল চাকরি হারান। জরিমানা গুণতে হয় হাজার পাউন্ড।
পল খুবই সৌভাগ্যবান ছিল। কারণ অনলাইন মিডিয়াতে তার এ খবর ফলাও করে আসতে থাকে। টুইট ব্যবহারকারীরা তার পক্ষে আওয়াজ তোলে। এরপরও বিচার প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। শেষে আদালত রায় দিয়ে বলল, আক্রমণাত্মক যেকোনো মন্তব্য যা সমাজে ক্ষতির বা ভয়ের সৃষ্টি করতে পারে; সে ধরনের যেকোনো মন্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এ বছরই আফগানিস্তানে ছয় ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হওয়ার পর ২০ বছর বয়সী আজহার আহমেদ ফেসবুকে ব্রিটিশ সেনাসদস্যদের উল্লেখ করে বলেছেন, তোমাদের মরতেই হবে এবং জাহান্নামে যাও। এর কিছুক্ষণ পরই আজহার পোস্ট ডিলিট করে দেন। কিন্তু তারপরও গ্রেপ্তার এড়ানো যায়নি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণাত্মক হওয়ার অপরাধে প্রত্যেককে ২০০৩ সালে ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন অ্যাক্টে গ্রেপ্তার করার বিধান আছে। এ আইনটি তৈরি হয় ১৯৩০ সালে। টেলিফোনে হুমকি এবং কাউকে অনৈতিক উত্ত্যক্ত করার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এ আইন করা হয়। এটি অবশ্য ২০০৩ সালে সংশোধিত হয়। কিন্তু ফেসবুক এবং টুইটারের যুগ এরও পরে পর শুরু।
এ সময়ে ইন্টানেট জগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মানুষের বক্তব্য, মন্তব্যও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে আইনের কথাও ভাবছেন। আদালত মনে করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের মতামত গঠনমূলক হওয়া উচিত।
জার্মানিতে এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা বিদ্যমান। দেশটির নিও-নাজি গ্রুপের টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছে টুইটার। এ প্রসঙ্গে টুইটারের পক্ষে বলা হয়, জার্মান কর্তৃপক্ষ তাদের এ অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিতে অনুরোধ জানিয়েছে।
এতো আইনের ফাঁদে বাধাগ্রস্থ হতে পারে মানুষের মুক্তমত। এমনই আশঙ্কা করছেন বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়ার পাঠকেরা। তারা এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথাও বলেছেন। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করে মুক্তমতকে বাধা দেওয়া কোনোভাবেই কেউ মেনে নেবে না বলে বিশ্বব্যাপী সোচ্চার হয়ে উঠেছে জনমত।
সোশ্যাল মিডিয়ার বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সামনের সময়গুলো হবে সোশ্যাল মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষার সময়। মানুষ নিজের মতামতকে ইন্টারনেট দুনিয়ায় তুলে ধরার স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলন করবে।
পল চ্যাম্বারসের জীবনে এক টুইটবার্তার জন্য যে ভয়াবহতা নেমে এসেছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কেউ পড়তে চায় না। কিন্তু পল সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, এখন বড় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। আমি ভেঙে পড়িনি। পড়বও না। তবে আমি যে জন্য লড়েছি সেজন্য যেন অন্য কাউকে লড়তে না হয়।
বাংলাদেশ সময় ২২১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১২
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর