ঢাকা: রইসুল কবির। আইটি প্রতিষ্ঠান ব্রেইন স্টেশন-২৩ ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।
ঢাকার মহাখালিতে তার নিজস্ব সুপরিসর অফিসে বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের আইটি সেক্টর, অনলাইন, বিশ্বে নিজের ফার্মের পরিচিতি, আউটসোর্সিং এবং নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেন।
কবিরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতে। টিএন্ডটি কলোনী স্কুল, গভ: ল্যাবরেটরী হাইস্কুল, নটরডেম কলেজ হয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে( বুয়েট) লেখাপড়া। চাকরি খোঁজার চেয়ে নিজে কিছু করতে চাইলেন।
২০০৬ সালের আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠা পায় ব্রেইন স্টেশন-২৩। শুরুতে কর্মী ছিল মাত্র চারজন। এখন ফুলটাইম কর্মী ৮০ জন। এখন প্রতিমাসেই জনবল বাড়ছে। স্বপ্ন বিশ্বজয়ের। প্রেরণা ইনফোসিস, গুগল, ইয়াহু, টাটা আর মাইক্রোসফট।
ফ্রি ল্যান্সার থেকে সিইও:
রইসুল কবিরের ভাষায় আমরা চারজন শুরু করলাম। আমি, গোলাম মহিউদ্দিন, মামনুন মুর্শেদ, মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ। আমি বাদে বাকি তিনজনই বুয়েট থেকে আর্কিটেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। আমি পড়েছি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিষয়ে। বাকিরা সবাই আমার অনেক সিনিয়র। ওনাদের ল্যাটিচুড -২৩ নামে একটি ফার্ম আছে। ২০০২ থেকে প্রতিষ্ঠানটি থ্রিডি, অ্যানিমেশন এবং ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করে।
‘ল্যাটিচুড-২৩’ ফার্মটি বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজ করতো। বিদেশি ক্রেতারা তাদের কাছে অনলাইন সাপোর্ট ও সফটওয়্যার সাপোর্ট নিত। তাদের প্রতিষ্ঠানের একটা সফটওয়্যার ও অনলাইন সার্ভিস উইং করার কথা তারা ভাবছিলেন। আমি চাইছিলাম একটা আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যার সার্ভিস ফার্ম করার। সবার চিন্তা একত্রে করে শুরু হলো ‘ব্রেইন স্টেশন-২৩’ নামে প্রতিষ্ঠান।
রইসুল কবির বলেন, বুয়েটে পড়ার সময় ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশি ক্লায়েন্টের জন্য কাজ করতাম। ২০০৫ সালে ইন্টারনেটে ফিল্যান্সিং শুরু করি। ধীরে ধীরে ভালো আয় হতে শুরু করে। অনেক কাজের অর্ডার পাচ্ছিলাম। এত কাজ একা সামলে উঠতে পারছিলাম না।
আসার আগে মনে হলো দেশে বসে কাজ করে বিদেশি টাকা আয় করতে পারবো। অনেকগুলো লোকের কর্মসংস্থান হবে। এটা সব মিলিয়ে খুব ভালো ব্যাপার মনে হলো। আমার টার্গেট ছিল অনেক মানুষ নিয়ে কাজ করবো। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে কাজ করবো। তাই সাহস করে শুরু করলাম।
তিনি বলেন, শুধু নিজের জন্য অনেক টাকা বানাবো এটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। ফলে প্রতিষ্ঠানের যা টাকা আয় হতো পুরোটাই আবার বিনিয়োগ করতাম। এভাবে আমরা এগিয়ে যাই। আমি চলার পথে খুবই ভালো সহকর্মী পেয়েছি।
স্বপ্ন ইনফোসিস:
স্বপ্নের কথা বলতে তিনি বলেন, ভারতের অন্যতম বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসে ৫০ হাজার মানুষ আইটি নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশে অন্তত যদি ৫ হাজার লোক নিয়োগ করতে পারি, তবে আমি সুখী হবো। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছি। ন্যূনতম ৫ হাজার দক্ষ আইটি এক্সপার্ট নিয়ে আমি প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করতে চাই।
কাজর অভিজ্ঞতার বিষয়ে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বাস্তব কাজে নেমে আমি দেখেছি থিওরি বা ধারণার চেয়ে কাজের অভিজ্ঞতা মানুষকে সবকিছু ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করে। আইটি সেক্টরে টাকার চেয়ে মেধার ব্যবহার ও জনশক্তি বেশি দরকার।
দেশে অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে আছে। তাদেরকে কাজে লাগাতে আইটি সেক্টর বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। বড় ধরনের বা বিশাল বড় পুঁজির চেয়েও তথ্য, যোগাযোগ, জনশক্তি, সৃষ্টিশীল চিন্তা বেশি জরুরি।
মানুষ আইটিতে পজেটিভ:
বিশ্বাসী রইসুল বলেন, আমি আত্নবিশ্বাসী, আশাবাদি এবং ইতিবাচক চিন্তার মানুষ। আমি তাই বড় বড় সফলতার স্বপ্ন দেখি। বলতে পারেন স্বপ্ন আর কাজ নিয়েই বেঁচে আছি। ভবিষ্যতে দেশে আইটি সেক্টর থেকে লাখ লাখ মানুষের অনেক টাকা আয় হবে। দেশের মানুষ আইটির ব্যাপারে পজেটিভ। আরও পজেটিভ হবে। এভাবেই দেশের আইটি সেক্টর এগিয়ে যাবে।
ব্রেইন স্টেশনের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, দিন দিন মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হচ্ছে। এখন মানুষ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে। মানুষের যখন আয় বাড়ে, তখন ভালো জীবনযাপনে টাকা কত ব্যয় হলো তা চিন্তার বিষয় থাকে না। সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের প্রতিদিনের জীবনে আইটির প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। ফলে আইটি সেক্টর বড় প্রভাব ফেলছে অর্থনীতিতে।
ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আইটি খাতের কারণে বিশ্বে প্রভাবশালী ভারতের কথা ভাবুন। সেখানে ১০ বছর আগে এ রকম পরিস্থিতি ছিল না। বাংলাদেশে যদিও গার্মেন্ট এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে। সঙ্গে আইটি সেক্টর উন্নতি করছে।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পোষাকশিল্পও আইটি সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। গার্মেন্ট সেক্টরে ইমেজ প্রসেসিং, ডিজাইন ছাড়াও প্রায় কারিগরি সব সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। সব কাজ মনিটরিং, যোগাযোগ, বিদেশি ক্রেতাকে নমুনা অনলাইনে দেখানো হচ্ছে। সব ধরনের ম্যানেজমেন্টে অনলাইন আর সফটওয়্যার ব্যবহার আন্তর্জাতিক কারণেই বাড়ছে।
জীবনে আইটি ও ইন্টারনেট:
দেশের ইন্টারনেটের ব্যপারে তিনি বলেন, ইন্টারনেটের গতি ও সংযোগ আইটি সেক্টরে নানা সমস্যা তৈরি করছে। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যয় কমাতে হবে। তবে আশার কথা ডিজিটাল স্লোগানের কারণে সবার মধ্যে আইটি সেক্টর, সফটওয়্যার, অনলাইন, ওয়েবসাইট, ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগ নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। নীতিনির্ধারকরাও সচেতন হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটা প্রজন্ম আসবে, যাদের জীবনের সব কিছুতে টেকনোলজি, ইন্টারনেট এবং মোবাইল সব থেকে বেশি প্রভাব রাখবে।
নিজেদের কাজের ধরনের ব্যপারে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা প্রধানত ওয়েব অ্যাপলিকেশন, মোবাইল অ্যাপলিকেশন, এন্টারপ্রাইজ অ্যাপলিকেশন, বিজনেস অ্যাপলিকেশন বা অনলাইন সাপোর্ট নিয়ে কাজ করি।
আমাদের নতুন তৈরি একটি রিয়েল এস্টেটে অ্যাপলিকেশন আছে। কানাডার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এটা ব্যবহার করছে।
অনলাইনে বাংলাদেশ:
অনলাইন বিশ্বে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এটা যারা উপলব্ধি করতে পারছে না তারা পিছিয়ে আছেন। অনলাইনে এখন বাংলা ভাষায় সেবা বা কনটেন্টের ব্যবহার বাড়ছে। নতুন নতুন অনেক কাজ হচ্ছে। মাত্র ক’বছরে অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য, তথ্যপ্রবাহ, অর্থনৈতিক লেনদেন ও সব ধরনের সেবার শিল্পটা অপ্রত্যাশিতভাবে বড় হয়ে উঠবে। কারণ অনলাইনের বিশ্ব প্রতিদিনই বড় হচ্ছে।
সব জায়গাতেই একটা পরিবর্তন আসছে। যেসব অ্যানালগ প্রতিষ্ঠান আগে ফাইলপত্র ব্যবহার করত। তারা কম্পিউটার, অনলাইন সিস্টেম এবং সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছে। অনেকে ব্যবসায় নামছে। এভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আইটি সেক্টরে নানাভাবে বিনিয়োগ করছে।
সব ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি নিচের পরিচিতি বা প্রয়োজনে ওয়েবসাইট বানাচ্ছে। এক সময় অনেক মানুষ নিজের নামেও ওয়েবসাইট তৈরি করে নিজের তথ্য এবং ছবি দিতে আগ্রহী হবে। সব সেক্টরে এমআইএস বা ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। সব প্রতিষ্ঠান এখন আইটি ও অনলাইনের জন্য দক্ষ জনবল রাখছে। আলাদা বাজেটও বরাদ্দ রাখছে।
তরুণ প্রজন্মের ধারন ক্ষমতা বেশি। তরুণেরা যত সহজে একটি নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ব করে, অন্যরা সেটা সহজে পারে না। তাই এ খাতে তরুণেরা ভালো করছে।
আইটি সেক্টর নানা কারণে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দায় সব খাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্ত আইটি সেক্টর সহজে আক্রান্ত হয় না। বরং অন্য সেক্টরের উন্নতি এর ওপর নির্ভর করে।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ পরিবর্তন হবেই। কারণ এখন সবাই একেকজন বিশ্ব নাগরিক। এখন আইটি শুধু কম্পিউটারের ফ্রেমে সীমাবদ্ধ নয়। এখন মোবাইল প্রায় সবার হাতে। নোটপ্যাড, আইপ্যাড, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট সবাই ব্যবহার করতে চায়। এমনকি অ্যানড্রইড টিভিও বাজারে এসেছে। মোবাইলে অনলাইন ব্যবহারকারী এখন কোটিরও বেশি। অনলাইনের জন্য পজেটিভ বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে।
জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার আয়োজিত বিটুবি প্রোগ্রামের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হয়ে কাজ করার পর আমরা বিশ্বের অনেক দেশে প্রশংসিত হই। আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, সমালোচক ও ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের উপদেষ্টা রিচার্ড সাইকেস এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কে জেনেছেন। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর মধ্যে বাংলানিউজ এ সংবাদ প্রথম প্রকাশ করে এজন্য বাংলানিউজকে ধন্যবাদ।
রইসুল কবির বলেন, আমরা ঢাকায় বসে বিশ্বের অনেক দেশের জন্য আইটি সেবা দিচ্ছি। আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। আমরা অত্যন্ত আশাবাদি একটা গুগল, ইয়াহু, মাইক্রোসফট, টাটা, রিলায়েন্স, ইনফোসিস একদিনে তৈরি হয়নি। আমরাও তাদের মতো একদিন পারব। আমরা দেখিয়ে দেব আমরাও পারি।
বাংলাদেশ সময় ১২১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১২
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর