ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

রাজনৈতিক লাইসেন্সে আইজিডাব্লিউতে ছাড়!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
রাজনৈতিক লাইসেন্সে আইজিডাব্লিউতে ছাড়!

ঢাকা: প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সংখ্যক লাইসেন্স প্রদান, কারিগরি জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক পরিচয়ে লাইসেন্স প্রাপ্তি, রাজস্ব আয়ের অর্থ সরকারের সঙ্গে ভাগাভাগি না করাসহ বহুবিধ কারণে দেশের আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডাব্লিউ) খাত ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।
 
হালে পরীক্ষামূলকভাবে তা চালুর কথা বলে ‌‌‌দেশে আসা আন্তর্জাতিক কলের রেট 'অনির্দিষ্টকালের' জন্য অর্ধেক করা এবং আইজিডাব্লিউ অপারেটরগুলোকে সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে অনুমোদন দেওয়ায় খাতটি  একটি গোষ্ঠীর কাছে আটকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


 
২০১২ সালের এপ্রিলে দেশে প্রথমবারের মতো দেওয়া হয় টেলিযোগাযোগ খাতে 'রাজনৈতিক লাইসেন্স'! রাজনৈতিক লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজস্ব ভাগাভাগি না করা, বিপুল অংকের বকেয়া পরিশোধ না করায় ২টির লাইসেন্স বাতিল, একাধিক অপারেটরের অপারেশন (অন্তত ৪টি) স্থগিত আছে।  

আর সরকারের পাওনা পরিশোধ না করায় দু'টি আইজিডাব্লিউর (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) লাইসেন্স বাতিল করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। গত ১২ মে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে আইজিডব্লিউ দু'টির লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়।
 
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক প্রতিটি ইনকামিং কল দেশে আসে আইজিডাব্লিউ গেটওয়ে হয়ে। গেটওয়ে কলটি আইসিএক্স অপারেটরকে পাঠায়। আইসিএক্স অপারেটর মোবাইলফোন বা ল্যান্ডফোনে পাঠিয়ে দেয়। ফলে গ্রাহক বিদেশে কথা বলতে পারে।     
 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত দেশে  আইজিডাব্লিউ অপারেটর ছিল একটি, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নিলামের মাধ্যমে আইজিডাব্লিউ লাইসেন্স দেয় টেলিযোগ‍াযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
 
২০১২ সালে আইন সংশোধন করে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা বিটিআরসির কাছ থেকে নিয়ে নেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ওই বছরই মন্ত্রণালয় আইজিডব্লিউ'র একাধিক লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নিলে বিটিআরসি মাত্র ৪টি লাইসেন্স দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করে। কিন্তু সরকার বিটিআরসির সুপারিশ আমলে না নিয়ে ২৫টি লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করে। ওই বছরের ১২ এপ্রিল মন্ত্রণালয় ২৫টি লাইসেন্স দেয়। লাইসেন্স দেওয়া হয় সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। সেই থেকে অরাজকতার শুরু বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
 
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সে সময় আইজিডাব্লিউ লাইসেন্স পায় কে টেলিকম, ভিশন টেল, সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, হামিদ সোর্সিং (বর্তমানে সংবার্ড টেলিকম লিমিটেড), রুটস কমিউনিকেশন্স, রাতুল টেলিকম, মস-৫ টেল, ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স, টেলেক্সবিডি, বাংলাটেল, ফার্স্ট কমিউনিকেশন্স ইত্যাদি।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতি আগ্রহে এবং বিটিআরসির উদ্যোগের ফলে নমনীয় হয় অর্থমন্ত্রণালয়। নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়, পরীক্ষামূলকভাবে ৬ মাসের জন্য কলরেট অর্ধেক করা হবে। অবশেষে গত ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাব (কলরেট অর্ধেক) অনুমোদন করলে বিটিআরসি নোটিশ জারি করে ১৮ সেপ্টেম্বর। নোটিশ জারির দিন থেকে পরবর্তী ৬ মাসকে (১৭ মার্চ পর্যন্ত) পরীক্ষামূলক মেয়াদকাল ধরা হয়। সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগির হার ছিল বিটিআরসি ৫১.৭৫, আইজিডব্লিউ অপারেটর ১৩.২৫, আইসিএক্স (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) ১৫ এবং এএনএস (একসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস) ২০ শতাংশ।
 
কলরেট অর্ধেক করা হলে (৩ সেন্ট থেকে দেড় সেন্ট) রাজস্ব ভাগাভাগির কাঠামোও পরিবর্তন করে বিটিআরসি। এ সময় রাজস্ব ভাগাভাগির হার দাঁড়ায় বিটিআরসি ৪০ শতাংশ, আইজিডব্লিউ অপারেটর ২০, আইসিএক্স ১৭.৫ এবং সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অপারেটর এএনএস পাবে ২২.৫ শতাংশ।
 
পুনর্নিধারণ করার পরে রাজস্ব ভাগাভাগির মডেল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নতুন মডেলে কেবল বিটিআরসির ভাগের আয় কমেছে ১১.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে আইজিডাব্লিউ, আইসিএক্স ও এএনএস অপারেটরের রাজস্ব প্রাপ্তির হার (আয়) বাড়ানো হয়েছে। আইজিডাব্লিউর বেড়েছে ৬.৭৫, এএনএস অপারেটরের বেড়েছে ২.৫ এবং আইসিএক্স এর বেড়েছে ২.৫ শতাংশ আয়।
 
পরীক্ষামূলক কলরেটের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ১৭ মার্চ। তবে তার আগের দিনই মেয়াদ বৃদ্ধির নির্দেশনা জারি করা হয়। বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ জুলফিকার স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বলা হয় 'পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট এবং তৎ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের রেভিনিউ শেয়ার মডেল বলবৎ থাকবে। '

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স এবং এএনএস অপারেটরগুলোকে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান এবং একটি শক্ত আর্থিক ভিত্তি দিতেই বিটিআরসি ছাড় বা সুবিধা দিয়েছে।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিটিআরসি নিজেই এই মেয়াদ বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
 
এদিকে কলরেটের মেয়াদ 'অনির্দিষ্টকাল' বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জানা গেল, বিটিআরসি আইজিডাব্লিউ অপারেটরগুলোকে (৭টি) 'সিন্ডিকেট গঠন' -এর অনুমতি দিয়েছে। গত ২৪ মার্চ বিটিআরসি এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে আই‌‌‌জিডাব্লিউ অপারেটরগুলোকে 'নেটওয়ার্ক টপোলজি' অনুসরণ করতে বলেছে। ২৪ এপ্রিলের মধ্যে আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স এবং এএনএস অপারেটরগুলোকে এই টপোলজি অনুসারে কল আনা এবং পাঠানোর কথা বলা হয়। এই ৭টি আইজিডাব্লিউ অপারেটর হলো মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক, নভো টেলিকম, ইউনিক ইনফোওয়ে, রুটস কমিউনিকেশনস, গ্লোবাল ভয়েস ও ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশনস।

নভো টেলিকমের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সক্ষমতা যাচাই এবং অপারেশনাল দায়িত্ব ঠিক না হওয়ায় নেটওয়ার্ক টপোলজি চালু করা সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, সব প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে আগামী ১ বা ১৫ জুন নেটওয়ার্ক টপোলজি চালু হতে পারে।   
 
আইজিডব্লিউ অপারেটরগুলোর সংগঠন আইওএফ দেশে ২৯টি আইজিডব্লিউ থাকলেও (বর্তমানে ৬টি স্থগিত রয়েছে) এই সাতটি প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক কল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ ব্যবস্থায় ৭টি অপারেটর আঙুল ফুলে কলা গাছ হবে এবং অবৈধ ভিওআইপি আরও উৎসাহিত হবে।
 
বিটিআরসি এ-ও বলে দিয়েছে, আগে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করতে হবে।

বিটিআরসি  বিষয়টি দেখে সন্তুষ্ট হলে তা বাণিজ্যিকভাবে অনুমোদন দেবে। তবে এ বিষয়ে কসটেলের প্রধান নির্বাহী এ কে এম শামসুদ্দিন জানান, দেড় বছরের জন্য এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দেড় বছর পরে আবার নতুন করে ৭টি অপারেটর চূড়ান্ত হবে। পুরনো ৪টি অপারেটর থাকবে এবং নতুন ৩টি অপারেটর যুক্ত হয়ে 'আন্তর্জাতিক কল' পরিচালনা করবে।
 
এ কে এম শামসুদ্দিন বলেন, এতে করে ছোট অপারেটরগুলো (টিয়ার-২) বিশাল বিনিয়োগ করা থেকে বেঁচে যাবে।

কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সরাসরি কল আনা নেওয়া করতে হলে অপারেটরগুলোকে বিশাল অংকের টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে যা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে ছোট অপারেটরগুলো স্বল্প পরিমাণ (ন্যূনতম ৫৫ লাখ টাকা) টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ওই ৭টি অপারেটরের প্রত্যেকটিকে এই নতুন মডেলে ২০০ কোটি টাকার ওপর বিনিয়োগ করতে হবে। এতে করে ছোট ছোট অপারেটরগুলোর বিনিয়োগ ঝুঁকি নিয়ে নিচ্ছে বড় অপারেটরগুলো।  
 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কল আনা থেকে সব অর্থই (বিটিআরসির অংশ বাদে) একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসেবে জমা হবে)। ওই টাকা মাস বা নির্দিষ্ট সময় শেষে টিয়ার-২ এর অপারেটরগুলোর মধ্যে (সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর পাওনা পরিশোধের পরে) লভ্যাংশ ভাগ হবে ১:১.৯০ অনুপাতে। অর্থাৎ ছোট অপারেটররা কল এনে যা লাভ করবে তা ১:১.৯০ অনুপাতে ভাগ হবে।

ধরা যাক, ছোট অপারেটররা লাভ পেল ১০০ টাকা, তাহলে মোড়ল অপারেটররা পাবে ১৯০ টাকা। অর্থাৎ লাভের প্রায় দ্বিগুণ চলে যাবে মোড়লদের পকেটে। এ প্রক্রিয়ায় ছোট অপারেটরগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
 
লভ্যাংশ বণ্টনের অনুপাত এবং কল আনা এই দুই প্রক্রিয়ার ফলে মোড়ল অপারেটরগুলোর আয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ছোটগুলোর আয় বাড়লেও মাস বা বছর শেষে তা তারা ঘরে নিতে পারবে কি না তা নিয়েই এখন সন্দিহান আইজিডাব্লিউ অপারেটররা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।