ঢাকা, শনিবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩২, ০৩ মে ২০২৫, ০৫ জিলকদ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ–ভারত বাণিজ্যে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ, রপ্তানিতে কী প্রভাব পড়বে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:০৬, মে ২, ২০২৫
বাংলাদেশ–ভারত বাণিজ্যে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ, রপ্তানিতে কী প্রভাব পড়বে?

কয়েক মাস ধরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিম্নগামী। তিক্ত সম্পর্কের জেরে দেশ দুটি সম্প্রতি পরস্পরের বিরুদ্ধে বাণিজ্যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।

এর সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।

স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা করতে গত মাসে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারত বাতিল করার এক সপ্তাহের মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা।

দেশ দুটির মধ্যে যখন এ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে, তখন উভয় দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য পরিবহনে খরচের হিসাব কষতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।  

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ

পোশাকশিল্পে প্রভাব

পোশাক কারখানার জন্য অত্যাবশ্যক কাঁচামাল সুতা এখন সমুদ্র ও আকাশপথে আমদানির বিকল্প পরিকল্পনায় ব্যস্ত বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। যদিও এভাবে পণ্য আমদানি ধীরগতির এবং ব্যয়বহুল।

২০২৪ সালে ভারত ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার (১৬০ কোটি) মূল্যের সুতা বাংলাদেশে রপ্তানি করেছিল, যার এক তৃতীয়াংশই আসে স্থলবন্দর দিয়ে। অন্যদিকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধায় বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা উচ্চমানের ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাক সড়কপথে ভারতে পাঠাতেন, সেখান থেকে এসব পণ্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিমানযোগে পাঠানো হতো। কিন্তু ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর থেকে সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না।

অর্থাৎ, সম্পর্কের অবনতিতে আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে দুই দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানেই উদ্বেগ বেড়েছে।

বিষয়টিকে বাংলাদেশের ‘ফাস্ট-ফ্যাশন রপ্তানি শিল্পে’র জন্য বড় ধাক্কা উল্লেখ করেছেন সাপ্লাই চেইন ফার্ম এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ। বিশ্বখ্যাত জারা’র মতো ব্র্যান্ডের জন্য পণ্য পরিবহন করা এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভারতের রুট দিয়ে যে পণ্য এক সপ্তাহে পশ্চিমা দেশগুলোতে পরিবহন করা হতো, সমুদ্রপথে তা পরিবহনে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। ’

ভারত থেকে স্থলপথে তুলা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাংলাদেশ

আনিস আহমেদ তথ্য দেন, চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ গত বছর ৩৮ বিলিয়ন ডলারের (৩ হাজার ৮০০ কোটি) পোশাক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারেরও (১০০ কোটি) বেশি পণ্য ভারতে স্থল-বিমান রুট দিয়ে পাঠানো হয়েছে, যা আনিস আহমেদের মতে ছিল বেশ কার্যকর।  

বাংলাদেশের সীমিত বিমান পরিবহনক্ষমতা এবং সরঞ্জাম ও সুযোগ-সুবিধার ঘাটতিতে থাকা বিমানবন্দর সরাসরি রপ্তানিতে এক বড় প্রতিবন্ধকতা।

চীন সফরে ড. ইউনূসের মন্তব্যের প্রভাব

অনেকেই দিল্লির ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন।

অধ্যাপক ইউনূস ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য বাংলাদেশকে ‘সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন ও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এ অঞ্চল ‘চীনা অর্থনীতির একটি সম্প্রসারণ’ হয়ে উঠতে পারে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেতারা এ মন্তব্যকে ‘আক্রমণাত্মক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। মুহাম্মদ ইউনূসের এ মন্তব্য চীনের সঙ্গে সীমান্তে ভারতের কৌশলগত ঝুঁকি বা দুর্বলতা তুলে ধরেছে। আর এটিই দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করেছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মাত্র ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত শিলিগুড়ি করিডোর (‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত) দিয়ে যুক্ত, যা নেপাল ও বাংলাদেশবেষ্টিত এবং তিব্বতের চুম্বি উপত্যকার কাছে অবস্থিত। সীমান্ত উত্তেজনার ইতিহাস এবং ১৯৬২ সালে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকারীরা আশঙ্কা করছেন যে, চীন ভবিষ্যতে যেকোনো সংঘাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য করিডোরটিকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে।

এছাড়া চীন সফরে বাংলাদেশের উত্তরে ১ বিলিয়ন ডলারের তিস্তা নদী প্রকল্পে বেইজিংয়ের আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ খবরে ভারতীয় বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, শিলিগুড়ি করিডোর থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন প্রকল্পে চীনের জড়িত থাকা দিল্লিকে অস্থির করতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূসের মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে করা হয়েছে।

বড় প্রভাব পড়েছে পর্যটন খাতে

ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রভাব পড়েছে দুই দেশের পর্যটন খাতেও। তবে এ ক্ষেত্রে বেশি বিপাকে ভারতীয়রা। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ভারতে যাওয়ার ভিসার অনুমোদন অনেকটাই কমে গেছে। ভারত ভিসা–সংক্রান্ত নিয়মকানুনে কড়াকড়ি করায় বাংলাদেশে অসন্তোষ বাড়ছে।

আগে পর্যটন, ব্যবসা, শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর দুই মিলিয়ন (২০ লাখ) বাংলাদেশি ভারতে যেতেন। স্থানীয় গণমাধ্যমের মতে, গত কয়েক মাসে প্রতিদিন জারি করা ভিসার সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি কমেছে।

হাসিনার ভারতে অবস্থান-প্রত্যর্পণের দাবির প্রভাব   

সম্পর্কের তিক্ততাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন ভারতে স্বৈরাচার হাসিনার অবস্থান এবং তাকে প্রত্যর্পণের দাবি। বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে বড় ‘অস্বস্তির’।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্যাম শরণ বলেছেন, বাংলাদেশকে বুঝতে হবে, হাসিনাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। আমরা জানি তাকে হস্তান্তর কলে তার কী পরিণতি হবে। আমি মনে করি, ভারতের জনমতও এটা সেটি সমর্থন করবে না।  

ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে, ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারকদের সমিতি স্থলপথে বাংলাদেশি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, আরও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আত্মঘাতী হতে পারে।

ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশে এখন একটি দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যে, ‘আগের (হাসিনা সরকার) প্রদত্ত ভারতকে (দেশটির উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য) দেওয়া ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। ’ 

ভারত তার স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশি বন্দর, রাস্তা এবং জলপথ ব্যবহার করে। যার ফলে দূরত্ব, সময় এবং খরচ কম হয় তাদের। তবে দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, এই পথে প্রত্যাশিত পরিমাণে পণ্য পরিবহন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ -পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগ

এদিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের মধ্যে দিল্লি-ঢাকা উত্তেজনা বাড়ছে। শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনামলে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ গত মাসে ঢাকা সফর করেন, পাকিস্তানের তরফে ১৫ বছরে বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম কোনো উচ্চপর্যায়ের সফর। গত সপ্তাহে ভারতনিয়ন্ত্রত কাশ্মীরে এক হামলার ঘটনায় নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ায় পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের এক পরিকল্পিত সফর অবশ্য স্থগিত হয়েছে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক বিষয়ে ভারতের সাবেক কূটনীতিক শ্যাস শরণ বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু আছে। তবে যদি এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, একসঙ্গে কাজ করে ভারতের জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তোলার কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে তাদের, তাহলে তা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হবে। ’

উভয়পক্ষের সরকারি প্রতিক্রিয়া ভারত এবং বাংলাদেশে জনমতকেও প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব দিন দিন বাড়ছেই, ভারতীয় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ‘ইসলামপন্থি’ হুমকি অতিরঞ্জিত করে দেখানোর অভিযোগ করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের সংশ্লিষ্টরা যদি শান্ত থাকতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের পদক্ষেপ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।

প্রসঙ্গত, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শেখ হাসিনা পালিয়ে বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে।

গত আগস্ট থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হতে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি করে আসছে ঢাকা। হাসিনা তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবির কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

এরইমধ্যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ ভারতের। সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ অস্বীকার করে এ ধরনের বেশিরভাগ ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা সাধারণ অপরাধ বলে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ।  

সংখ্যালঘু ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন মধ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বিবিসি অবলম্বনে

এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।