সীমান্তের অন্য পাশ থেকে ছোড়া গোলার আঘাতে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পুঞ্চ শহরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইকবাল নিহত হন। এই ঘটনা ঘটে ৭ মে সকালে।
ভারতের ওই হামলার জবাবে পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তান। ভারতের দাবি, এই হামলা ছিল কিছুদিন আগে পহেলগামে সংঘটিত হামলার প্রতিশোধ, যার জন্য তারা পাকিস্তানকে দায়ী করছে। তবে পাকিস্তান শুরু থেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
মোহাম্মদ ইকবালের ভাই ফারুক আহমেদ। ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেশ রাগান্বিত হয়ে পড়েন ফারুক। তিনি জানান, জিয়া-উল-উলুম মাদরাসায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করতেন তার ভাই। আর সেখানেই তিনি নিহত হন।
ইকবালের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ভারতে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল তাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে মিথ্যা অভিযোগ করতে শুরু করে। তবে স্থানীয় পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়ে জানায়, ওই অভিযোগ অসত্য।
ফারুক বলছিলেন, আমার ভাই একজন শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু তারা তার দাড়ি ও মাথার টুপি দেখেই তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। এটা যেন আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া।
তিনি বলেন, আমরা ইকবালকে হারিয়েছি। আর তারপরই গণমাধ্যম তাকে অসম্মান করল। মৃত মানুষ তো আর নিজের হয়ে কিছু বলতে পারে না!
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চারদিন ধরে চলতে থাকা সামরিক সংঘাতের সময়ে পাল্টা-পাল্টি গোলাবর্ষণে ইকবালসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তান ৪০ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে, তবে এর মধ্যে কতজন সরাসরি গোলাবর্ষণের কারণে মারা গেছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
একদিকে যখন সামরিক সংঘাত বাড়ছিল, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি লড়াই শুরু হয় – অনলাইন ও টেলিভিশনে ভুয়া খবর ছড়ানোর লড়াই।
ইকবালের পরিচয় নিয়ে যেমন গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তেমনই টিভি ও সংবাদ পোর্টালসহ মূলধারার গণমাধ্যমে আরও নানা বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল।
ভারতের একটি স্বাধীন সংবাদ পোর্টাল নিউজ লন্ড্রির ম্যানেজিং এডিটর মনীষা পাণ্ডে বলছিলেন, যে মাত্রায় ভুয়া তথ্য এবং যাচাই না করা তথ্য প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।
ইকবালের ভাই ফারুক আহমেদ বলছিলেন, আমি জানি না নিউজ চ্যানেলগুলো কোথা থেকে আমার ভাইয়ের বিষয়ে খবর পেয়েছিল। কার সঙ্গে কথা বলেছে তারা? আমার ভাই যে ‘সন্ত্রাসবাদী’, তার কী প্রমাণ ছিল তাদের কাছে?
ফারুক আহমেদ বলেন, ৭ মে তার ভাই প্রতিদিনের মতোই সকালে মাদরাসায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। তবে ফিরে আসে তার প্রাণহীন দেহটা। দুপুরের মধ্যে তারা তাকে বাড়ির কাছেই একটি কবরস্থানে দাফন করেন।
পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত ছিলেন ইকবালের দাফনে, তাই বেশ কিছুটা সময় পর্যন্তও তারা জানতেনই না যে সংবাদমাধ্যমের একাংশে একটা মিথ্যা খবর দেখানো হচ্ছে।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তাদেরই এক আত্মীয়ের কাছে একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আসে। সেখানে ছিল একটি নামকরা নিউজ চ্যানেলের একটি ভিডিও ক্লিপ।
তাতে দাবি করা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী এক ‘সন্ত্রাসবাদীকে’ হত্যা করেছে, খবরের সঙ্গে স্ক্রিনে ইকবালের ছবি ভেসে ওঠে। এই ঘটনায় ইকবালের পরিবার হতবাক হয়। লোকজন তাদের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইতে থাকে।
ইকবালকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে বর্ণনা করে খবর দেখিয়েছিল জি নিউজ, এবিপি এবং নিউজ এইটিন-সহ আরও কয়েকটি চ্যানেল। এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে ওই চ্যানেলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিবিসি।
একটি চ্যানেল দাবি করে যে ইকবাল পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে ‘সন্ত্রাসী শিবিরের ওপরে ভারতীয় হামলায়’ নিহত হয়েছেন এবং তিনি পাকিস্তান-ভিত্তিক ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার একজন সন্ত্রাসী’ ছিলেন।
ফারুক আহমেদ বলছিলেন, আমাদের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে পুঞ্চে বসবাস করছেন। এটা তারা কীভাবে বলল যে আমার ভাই পাকিস্তানে ছিল? তাদের (গণমাধ্যমের) লজ্জিত হওয়া উচিত।
ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এত ব্যাপকভাবে এবং এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে ৮ মে পুঞ্চ পুলিশ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে স্পষ্ট করে যে সীমান্তে পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের সময়ে মাদরাসার ভেতরেই মারা গেছেন তিনি।
পুলিশ বিবৃতিতে জানায়, নিহত ইকবাল এলাকার একজন সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তি ছিলেন এবং কোনো ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠনের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না
তবে এই বিবৃতি যখন আসে, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। এর আগেই ভুয়া খবরটা ভারতের লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। নিউজ এইটিন ছাড়া আর কেউই ওই ভুলের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়নি।
ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, তিনি মিথ্যা খবর প্রকাশ করা চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান, তবে তাতে কিছুটা সময় লাগবে, কারণ তার পরিবারকে তো দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার লড়াইটা লড়তে হচ্ছে এখন।
ইকবালের দুই স্ত্রী ও আট সন্তান রয়েছে। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
আরএইচ