ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২, ০৩ জুলাই ২০২৫, ০৭ মহররম ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

‘ব্লাড গোল্ড’ যেভাবে পশ্চিম আফ্রিকায় সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে

আন্তজার্তিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:১১, জুলাই ২, ২০২৫
‘ব্লাড গোল্ড’ যেভাবে পশ্চিম আফ্রিকায় সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে

২০২৫ সালে সোনার দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ার ফলে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের তিনটি দেশ বুরকিনা ফাসো, মালি এবং নাইজারের সোনার খনিগুলো তাদের সামরিক শাসকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব উৎস হয়ে উঠেছে।  

বছরে প্রায় ২৩০ টন সোনা উৎপাদনকারী এই অঞ্চলটি জিহাদি বিদ্রোহ এবং বিচ্ছিন্নতার মোকাবিলায় তাদের শাসকদের সাহায্য করে যাচ্ছে।

 

যদিও সরকারগুলি দাবি করে যে এই আয় সার্বভৌমত্ব বাড়াচ্ছে, তবে দেখা যাচ্ছে অঞ্চলটিতে রুশ কোম্পানিগুলো প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে মালির নতুন সোনা শোধনাগারে, যেখানে রাশিয়ার ইয়াদরান গ্রুপের অংশীদারিত্ব রয়েছে। বুরকিনা ফাসোও একটি শোধনাগার নির্মাণ করছে এবং বিদেশিদের হাতে থাকা খনিতে অংশীদারিত্ব দাবি করছে।  

অঞ্চলটিতে ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ট্রাওরেকে মতো নেতাদের নিয়ে প্রচারণা এখন তুঙ্গে। সোনার আয়ের বেশিরভাগই সামরিক অপারেশনগুলোকে অর্থায়ন করছে, যেখানে রুশ ভাড়াটে সৈন্যদের অংশগ্রহণ রয়েছে, যদিও সরকারগুলো এ ব্যাপারটি অস্বীকার করে।

সাহেল অঞ্চলে সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা কম, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বাজেটের বড় অংশ বরাদ্দ করা হয়। মালির সামরিক ব্যয় ২০১০ সালের পর থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে জাতীয় বাজেটের ২২% পর্যন্ত পৌঁছেছে। তারা আল-কায়দা ও আইএসের সঙ্গে যুক্ত জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াই করছে, কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলো মালির সরকার এবং রাশিয়ান ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে বেসামরিক লোকদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছে, যা বুরকিনা ফাসোর ক্ষেত্রেও একই রকম। ওয়াগনার এবং তার উত্তরসূরি আফ্রিকা কর্পসকে প্রায়ই সোনা বা খনিতে অংশিদারিত্ব দিয়ে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।

মালির ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে সরকারি কঠোর নীতি আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেমন জামাত নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল-মুসলিমিন (জেএনআইএম) যারা ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বুরকিনা ফাসোর সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ বাড়িয়েছে যা তাদের শক্তির ইঙ্গিত দেয়।  

সাহেল অঞ্চলের অনেক সোনা খনি হলো অনিয়ন্ত্রিত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষুদ্র ও কারিগরি খনি। যেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সরকার উভয়ই নিয়ন্ত্রণের জন্য সংঘাতে লিপ্ত। জঙ্গিরা সোনার আয় থেকে লাভবান হচ্ছে। এই সোনা গুলো প্রায়শই সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে আসে।

বিশ্বব্যাপী সোনার দাম বৃদ্ধি সাহেল অঞ্চলের সংঘাতকে দীর্ঘায়িত ও তীব্র করে তুলছে, কিন্তু ক্ষুদ্র খনি শ্রমিকরা তেমন লাভ দেখতে পাচ্ছে না।

মালির কিদাল অঞ্চলের এক সোনা শ্রমিক একটি ভাল দিনে প্রায় ১৮ থেকে ৩৬ ডলার উপার্জন করেন। সোনার বিশ্ব বাজার মূল্য বাড়লেও অতিরিক্ত মুনাফা যায় খনি মালিকদের কাছে, শ্রমিকরা এর কিছুই পান না।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে সোনা আফ্রিকার নতুন ‘সংঘাতজনিত পণ্য’ হয়ে উঠেছে, ঠিক যেমন অতীতে পশ্চিম আফ্রিকায় হীরার কারণে সহিংসতা বেড়েছিল। পরে কিম্বারলি প্রক্রিয়া ‘ব্লাড ডাইমন্ড’ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছিল।  

কিম্বারলি প্রক্রিয়া সার্টিফিকেশন স্কিম (কেপিসিএস) হলো ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রক্রিয়া, যা কাঁচা হীরার বাজারে ‘সংঘাতজনিত হীরা’র প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করতে তৈরি করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল হীরা বিক্রির অর্থ ব্যবহার করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও তাদের মিত্ররা যাতে বৈধ সরকারকে দুর্বল করার জন্য সহিংসতা চালাতে না পারে তা নিশ্চিত করা।

‘ব্লাড ডাইমন্ড’ এর তুলনায় ‘ব্লাড গোল্ড’ বা রক্তাক্ত সোনার নিয়ন্ত্রণ এখনো অনেক দুর্বল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মত গুরুত্বপূর্ণ শোধনাগার কেন্দ্র গুলোতে এখনো একটি একিভূত মানদণ্ড এবং তার যথাযথ প্রয়োগের অভাব রয়েছে।  

সোনা প্রক্রিয়াজাতকরণ দ্রুত হওয়ার কারণে এর উৎস নির্ণয় প্রায় অসম্ভব, এটি হীরার মতো নয়। ফলে সাহেল অঞ্চলের সোনা যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য বাজারে প্রবেশ করে কোনও স্পষ্ট নৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। হীরার চেয়ে সোনার সার্টিফিকেশন ব্যবস্থাও কঠিন কারণ এখানে  শুধু অবৈধ সশস্ত্র গোষ্ঠী নয় রাষ্ট্রও জড়িত থাকে। সাহেল সরকারগুলোর জন্য সোনার গুরুত্ব এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে ‘ব্লাড গোল্ড’ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যার মূল্য স্থানীয়দের চুকাতে হচ্ছে।

সূত্র: বিবিসি

এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।