ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে তেল আবিব সরকার কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ ও উদ্দেশ্যমূলক তথ্যগোপন করেছে বলে অভিযোগ করেছেন খ্যাতনামা ইসরায়েলি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাবিব ড্রাকার।
তিনি দাবি করেছেন, ইসরায়েলি পুলিশ তাকে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিত্রায়ন করতে বাধা দিয়েছে এবং সেন্সর বোর্ডের অনুমতির কথা বলে হুমকি দিয়েছে।
ইসরায়েলের চ্যানেল ১৩-এর এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছেন, “ইসরায়েলি সামরিক সেন্সর এখন কেবল নিরাপত্তা নয়, বরং সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ”
দখলকৃত অঞ্চলে প্রিভেন্টিভ সেন্সরশিপ চালানো গোয়েন্দা ইউনিটের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ইরানের হামলার ক্ষয়ক্ষতির ছবি তোলার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা আমাকে সরাসরি বাধা দিয়েছিল। আমি প্রেস কার্ড দেখালে তারা খানিকটা নরম স্বরে বলেছিল, ‘এখানে চিত্র ধারণ নিষিদ্ধ’। ”
ড্রাকার বলেন, দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে তিনি জানতে পারেন, যুদ্ধের সময় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাতপ্রাপ্ত পাঁচটি সামরিক ঘাঁটির মধ্যে একটি তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। কিন্তু সেন্সরশিপের কারণে তা গণমাধ্যমে আসেনি।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই সেন্সরশিপ ইরানকে ঠেকানোর জন্য নয়—কারণ তারা জানে কোথায় আঘাত করেছে। সেন্সরের মূল উদ্দেশ্য ইসরায়েলিদের কাছ থেকে সত্য লুকিয়ে রাখা, যেন জনগণের চোখে একটি জয়ের ‘বিভ্রম’ সৃষ্টি করা যায়। ”
ড্রাকার আরও বলেন, “এই সেন্সর জীবন রক্ষা করে না, বরং ব্যর্থতা ঢাকতে সাহায্য করে। সেন্সর এখন আর গোপন তথ্য রক্ষা করছে না, বরং সেগুলো আড়াল করছে, যা ইতোমধ্যে স্যাটেলাইটে ধারণ, টুইটারে প্রকাশ এবং টেলিগ্রামে বিশ্লেষণ হয়ে গেছে। ”
তিনি সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “আমরা কি এখনও সত্যের প্রহরী, নাকি এই প্রপাগান্ডার অংশীদার? অনারব দেশপ্রেমী তকমা এড়াতে আমরা মিথ্যার সঙ্গী হয়ে যাচ্ছি?”
রাবিব ড্রাকার আরও বলেন, “ইসরায়েলের সেন্সরশিপ ইউনিট নিজেই জানে তাদের ভূমিকা বদলে গেছে। আগে তারা সৈন্যদের জীবন বাঁচাত, এখন রাজনীতিবিদদের সম্মান বাঁচায়। আগে গোপনীয়তা রক্ষা করত, এখন স্যাটেলাইট, টুইটার ও টেলিগ্রামে প্রকাশিত তথ্য লুকোতে চায়। এটা এখন নিরাপত্তার নয়, প্রপাগান্ডার প্রশ্ন। আমরা একে ‘সামরিক সেন্সর’ বললেও আসলে এটি প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের ‘হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ’ ছাড়া কিছু নয়—যেখানে তারা নির্দেশনা পাঠায়। ”
ইসরায়েলি এই সাংবাদিক আরও দাবি করেন, এসব সামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখনো কার্যক্ষম রয়েছে।
এর আগে শনিবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ জানায়, ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের অন্তত পাঁচটি সামরিক স্থাপনায় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক স্যাটেলাইট রাডার তথ্য বিশ্লেষণ করে নতুন এই তথ্যগুলো দ্য টেলিগ্রাফকে জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ পত্রিকাটি আরও জানায়, ছয়টি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র অধিকৃত অঞ্চলের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। এর মধ্যে একটি ছিল গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ কেন্দ্র এবং অন্যটি একটি রসদঘাঁটি। এই পাঁচটি এলাকার বাইরে আরও ৩৬টি স্থানে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে বিভিন্ন আবাসিক ও শিল্পাঞ্চলের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। এই হামলাগুলো ইসরাইলি সেনাবাহিনী আগে গোপন রেখেছিল কঠোর সেন্সরশিপ নীতির কারণে।
১৩ জুন ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় আকস্মিক হামলা চালায়, যাতে শতাধিক সাধারণ নাগরিকসহ এক ডজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। জবাবে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’ নামে দখলকৃত অঞ্চলে ইসরায়েলের কৌশলগত সামরিক, গোয়েন্দা, শিল্প ও গবেষণা স্থাপনায় জোরালো প্রতিশোধ নেয়। ২৪ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। পরে ইরানও তা মেনে নয়।
সূত্র: ইরানের প্রেস টিভির ওয়েবসাইট থেকে অনূদিত।
এমজেএফ