ঢাকা: সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে স্নায়ু যুদ্ধের কবর রচিত হলেও আসলে স্নায়ু যুদ্ধের আসল মৃত্যু ঘটেনি। আগের মতো স্নায়ু যুদ্ধের উত্তেজনা না ছড়ালেও এখনও রয়ে গেছে।
সিরিয়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স একপক্ষে চলে গেছে, অন্য পক্ষে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। তাদের সঙ্গে কিছুটা রয়েছে ইরান।
রাশিয়া ও চীন কেন সিরিয়ার পক্ষ নিচ্ছে বা সিরিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে তা নিয়ে বিশ্লেষণী একটি প্রতিবেদন ছেপেছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক বা সিএনএন অনলাইন। তিনি প্রতিবেদনটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
রাশিয়া কেন সিরিয়াকে সমর্থন দেয়
সিরিয়াকে সমর্থন দেয়ার পেক্ষনে রাশিয়ার দুটি প্রধান কারণ রয়েছে- একটি অর্থনীতি, অন্যটি আর্দশ।
অর্থনীতি
সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের যোগানদাতা রাশিয়া। সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রাশিয়া ও ইউরোশিয়া প্রোগামের ডেপুটি ডিরেক্টর ও ফেলো জেফরে মানকোফের তথ্য মতে, সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের চুক্তির পরিমাণ ৪শ কোটি মার্কিন ডলারের ওপরে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসাবের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রতি বছরে সিরিয়ার কাছে ১৬ কোটি ২ লাখ মার্কিন ডলারের অর্থ বিক্রি করেছে।
যুদ্ধ প্রশিক্ষণ জেট (কমব্যাট ট্রেনিং জেট) নিয়ে সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়া ৫৫ কোটি মার্কিন ডলার অর্থের চুক্তি করেছে।
সিরিয়ার তারতুস নগরবন্দরে রাশিয়ার নৌঘাঁটি রয়েছে। এ তারতুসই ভূমধ্য সাগরে রাশিয়ার নৌবাহিনীর প্রবেশের একমাত্র পথ।
আদর্শ
রাশিয়ার মূল নীতি হচ্ছে সিরিয়া ও তার আশপাশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মুক্ত রাখা। রাশিয়া বিশ্বাস করে, বিপ্লব, যুদ্ধ আর শাসনের পরিবর্তন স্থিতিশীলতা বা গণতন্ত্র আনতে পারে না। এর উদাহরণ হিসেবে তারা সব সময়ই টেনে আনেন, আরব বসন্ত আর যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ইরাক যুদ্ধ।
ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মতলবের প্রতি সন্দেহ রয়েছে রাশিয়ার। মস্কোর অন্ধবিশ্বাস, মানবাধিকারের বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় তার নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে থাকে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সহযোগী প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আন্না নেইসটাট বলেন, ভূমধ্য সাগরে নিজের নৌ উপস্থিতিকে অটুট রাখার জন্য রাশিয়া শুধু (সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার) আল-আসাদকে সমর্থন দিচ্ছে না, এর পেছনে রয়েছে এনার্জি চুক্তি বা ‘শাসন (সরকার) পরিবর্তনে’ পশ্চিমাদের প্রভাবকে মোকাবিলা করা।
রাশিয়া কি বলছে
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ জোর দিয়ে বলেছেন, সিরিয়ার সরকারই যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে তার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনও নেই।
সিরিয়ার ওপর হামলার পরিকল্পনা জাতিসংঘ সনদকে চ্যালেঞ্জ করবে বলে জানিয়েছে ল্যাভরভের মন্ত্রণালয়।
ওয়াশিংটন ‘ভিত্তিহীন কৃত্রিম অজুহাত’ তৈরি করে সামরিক হামলার চালানোর পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করে রাশিয়া। বৈঠকে সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর প্রস্তাব এনেছিল যুক্তরাজ্য।
রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী দ্রিমিত্রি রোগোজিন টুইট করেছেন, বানর যেমনভাবে গ্রেনেড নিয়ন্ত্রণ করে তেমনিভাবে পশ্চিমারা ইসলামী বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে।
রাশিয়া কেন ফ্যাক্টর
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পরিষদের সদস্য। সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে রাশিয়ার এবং সেটা গত দুই বছরে বারবার প্রয়োগ করে দেখিয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি সামরিক হামলা চালাতে জাতিসংঘের সবুজ সংকেত পেতে চায় তাহলে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
চীন
সিরিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খুবই সুক্ষ্ণ। অনেকে বলেন, দু দেশের সম্পর্কের মূলে অর্থনীতি। ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্য মতে, ২০১০ সালে চীন সিরিয়ায় তৃতীয় রফতানিকারকের স্থান দখল করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ ইন্সটিটিউট দ্য জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের ২০১০ সালের প্রতিবেদন মতে, বেইজিং দামেস্কে নিয়ে নতুন করে স্বার্থ ঠিক করেছে। সিরিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে দেখছে চীন।
কিন্তু এর পেছনে আরও বড় ফ্যাক্টর রয়েছে।
চীন বলেছে, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানো উচিত হবে না-এবং সম্ভবত খুবই ভালো কারণে। তিব্বত নিয়ে নিজস্ব নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চীনকে ঘিরেই বিতর্ক রয়েছে।
পরিশেষে, লিবিয়ায় যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না চীন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব থেকে বিরত থেকে লিবিয়ায় ন্যাটোর হামলার চালানোর পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল চীন।
ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের এশিয়া প্যাসিফিক বুলেটিনে ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের ইয়ুন সান লিখেছেন, কিন্তু এটি হতাশাজনক ছিল। পশ্চিমারা বা এনটিসি (লিবিয়ান ন্যাশনাল ট্রান্সিশনাল কাউন্সিল) কেউও চীনের অনুপস্থিতির প্রশংসা করেনি।
তাই তিনি বলেছেন, সিরিয়ার ক্ষেত্রে বেশ সাবধান চীন। বুঝে-শুনে, সুক্ষ্ণভাবে এগুচ্ছে চীন।
আসাদ বা বিরোধীদের পক্ষ না নিয়ে বরং দূরে সরে থেকে ‘অবস্থা দেখে ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা ভাবচ্ছে চীন। উভয় পক্ষের জন্য সক্রিয়ভাবে বাজি ধরছে বেইজিং।
চীন কী বলছে
চীন বলছে, তারা কঠোরভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং জাতিসংঘের রাসায়নিক অস্ত্র পর্যবেক্ষকদের সমর্থন করে। সিরিয়ায় তারা রাজনৈতিক সমাধান দেখতে চায় চীন, যদিও অনেকে বলছেন, এ ধরনের আশা কবেই ছাই হয়ে গেছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং হি বলেছেন, সিরিয়ার ইস্যু নিষ্পত্তির একমাত্র বাস্তবিক পন্থা হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান।
রাশিয়ার মতো চীনও বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক থেকে প্রত্যাহার করে, যেখানে সিরিয়ার ওপর সামরিক হামলা চালানোর প্রস্তাব এনেছিল যুক্তরাজ্য।
চীন কেন ফ্যাক্টর
চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। রাশিয়ার মতো চীনও সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপগুলোতে বারবার বাধা দিয়েছে যাতে করে সিরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘে অচলাবস্থার তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৩
এসএফআই/এসআরএস