ঢাকা: সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বেড়ে ওঠা দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সম্পর্কে অধিকাংশ সিরীয়র ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, ভুলে পরিণত হয়েছে বাশারকে নিয়ে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী।
বাবা হাফেজ আল-আসাদ কিংবা ভাই মাহের ও বাসেল আল-আসাদ কারও সঙ্গে তুলনীয় ছিলেন না বাশার।
ছোটকালে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে বাশার ছিলেন একটি লাজুক, রক্ষণশীল, হাবাগোবা, দুর্বল এবং ইতস্তত চরিত্রের ছেলে।
বাশারের লম্বা আর শুকনো শারীরিক কাঠামো সিরিয়ার অধিকাংশ মানুষের কাছে তাকে দুর্বল ব্যক্তি হিসেবেই উপস্থাপন করেছিল।
নীল রঙা চোখের অধিকারী বাশার পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন চিকিৎসক। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে সিরিয়ার সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর কাছে বুকিশ (পড়ুয়া) হিসেবে পরিচিত ছিলেন বাশার।
আসাদ পরিবারের সমর্থকরা অনেকেই বাশারকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাননি। তাদের শঙ্কা ছিল, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেন না আসাদ।
ইরানি বংশোদ্ভূত সিরীয় লেখক ও স্কলার মজিদ রাফিজাদেহ সিএনএনের এক নিবন্ধে বাশার সম্পর্কে বলেছেন এসব কথা।
১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দামেস্কে জন্ম নেন বাশার আল-আসাদ। ১৯৮৮ সালে দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে সেনাবাহিনীতে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। এর চার বছর পর যুক্তরাজ্যে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য পাড়ি জমান।
বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন বাশার। টানা ৩০ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন হাফেজ আল-আসাদ।
মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মজিদ লিখেছেন, ক্ষমতার সংস্পর্শে বাশারের আসাটা ছিল আকস্মিক। ১৯৯৪ সালে বাবা হাফিজ আল-আসাদের কাছ থেকে একটি ফোনকল তার জীবনকে বদলে দেয়। ওই সময় যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টার্ন চক্ষু হাসপাতালে পড়াশোনা করছিলেন বাশার।
দুর্ঘটনায় বড়ভাই বাসেল আল-আসাদের মৃত্যুই তাকে সিরিয়ার সিংহাসনে বসার সুযোগ করে দেয়। প্যারাস্যুটিস্ট ও দক্ষ অ্যাথলেট বাসেলকে বাবার যোগ্য উত্তরসূরি মনে করা হতো।
দীর্ঘদিন জনসম্মুখের বাইরে থাকা এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকায় ছেলেকে হাফিজ আল-আসাদ ও তার জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা উপদেষ্টা কয়েক বছর সামরিক ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। নিজেদের সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টি ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ সম্পর্কেও ছেলেকে জ্ঞান দান করেন হাফিজ।
বাবার কাছে পাওয়া সামরিক আর আদর্শিক শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন ঘটে লাজুক বাশারের। ক্ষমতা গ্রহণের পর জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম বক্তব্যে সিরীয়দের চমকে দেন বাশার। তিনি জোরে সঙ্গে বলেন, ‘সিরিয়াকে আধুনিক করার সময় এখনই শুরু। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবো যা আমার জনগণের আশা ও বৈধ আকাঙ্ক্ষা মেটাবে। ’
মজিদ বলেছেন, ‘বাথ পার্টির সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং দেশের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান, আলাওয়াতি, শিয়া ও দ্রুজদের সহায়তা ও মন জয়ের চেষ্টা করতেন হাফেজ আল-আসাদ। কিন্তু ক্ষমতা নেওয়ার পর নতুন ধারায় দেশ শাসন করতে থাকেন বাশার। অর্থনৈতিক উদারতা, নব্য উদারতা ও পুঁজিবাদী নীতির পথে হাঁটা শুরু করেন বাশার। ’
খুব চতুরতার সঙ্গে এমন নীতি চালু করেন বাশার, যাতে করে সম্পদ ও পুঁজি নিজ চক্রের বিত্তশালীদের করায়ত্ত থাকে এবং একই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী শ্রেণিরও সমর্থন যেন পান।
কিন্তু অর্থনৈতিক নীতিতে পরিবর্তন আনলেও বাশার রাজনৈতিক নীতিতে হয়ে উঠেন স্বৈরশাসক। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান তিনি।
রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর রাজনৈতিক অত্যাচার-নিপীড়ন বাড়িয়ে দেন তিনি। যেসব সামাজিক গোষ্ঠী প্রশিক্ষক চিকিৎসক বাশারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাদের রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল করেন বাশার।
তার নীতির কারণে সিরিয়ায় ধনী আর গরিবের ব্যবধান দিনকে দিন বাড়তে থাকে। সিরিয়ার ওপর খবরদারি বাড়াতে ইরানের পথ প্রশস্ত করে দেয়।
যাদের হাত ধরে তিনি রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়েছিলেন এক সময় তাদের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয় বাশারের। সমাজতান্ত্রিক বাথ নীতি থেকে সরিয়ে আসায় বাশারের সঙ্গে কোন্দল বেঁধে যায় সিরিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান ও হাফিজ আল-আসাদের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা আলী দুবা, কট্টরপন্থি ভাই মাহের আল-আসাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের।
বাশার ও তার চক্র স্বল্প মেয়াদি সুফল পেলেও এর দীর্ঘ মেয়াদি পরিণতির বিস্ফোরণ ঘটে ২০১১ সালের মার্চে।
গণবিক্ষোভ শুরু হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শ্রেণির ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু (আলাওয়াতি, খ্রিস্টান, শিয়া, দ্রুজ) এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ভালো সাজতে চেষ্টা করেন বাশার।
আন্দোলনের মুখে দু’মুখো নীতি গ্রহণ করেন বাশার। একদিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিশ্রুতি দেন, অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের ওপর দমনপীড়ন চালান।
কিন্তু কতদিন আর শোষণ-দুর্নীতির ফল ভোগ করবেন আসাদ। ২০১১ সালের মার্চে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় বিদ্রোহে, শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বাশারের পতন ঘটাতে বাশারবিরোধী ও সিরীয় জনগণের একাংশ জোটবদ্ধ হয়। সামরিক বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন।
আড়াই বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে, ঘরছাড়া হয়েছে লাখো লাখো মানুষ।
এতোদিন পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ার বিদ্রোহীদের পরোক্ষভাবে বাশারবিরোধী যুদ্ধে সহায়তা দিয়ে আসলেও এখন তারা সরাসরি বাশারের ওপর হামলা চালাতে চান। ২১ আগস্ট রাজধানী দামেস্কে বিদ্রোহীদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে-এ অভিযোগে দেশটিতে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিচ্ছে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৩
এমজেএফ/জেসিকে