বার্লিন: ইউরোপ তথা বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি জার্মানির জাতীয় নির্বাচন ২২ সেপ্টেম্বর, রোববার। নির্বাচনের মাত্র দু’দিন বাকি থাকলেও দেশটির নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এর উত্তাপ খুব একটা লাগেনি।
এখানকার নিয়মই এমন, জনগণ তাদের বহু গণতান্ত্রিক দায়িত্বের মধ্যে ভোটপর্বকেও কেবল অন্যতম দায়িত্ব হিসেবেই দেখে। দেশটির নাগরিকদের কাছে ভোটই গণতান্ত্রিক অধিকারের একমাত্র উদাহরণ নয় বলে নির্বাচনী প্রভাব না পড়াটাই তাই স্বাভাবিক।
জার্মানির আসন্ন নির্বাচনে প্রধান দুটি দলের চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) প্রার্থী হলেন ক্রিস্টিয়ান রক্ষণশীল দলের (সিডিইউ) প্রধান অ্যাঙ্গেলা মর্কেল (বর্তমান চ্যান্সেলর) ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পিয়ার স্টাইনব্রুক।
বেশ কয়েক সপ্তাহ আগ থেকেই দেশটির জনগণের মাঝে একটা স্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, এবারও অ্যাঙ্গেলা মর্কেল দেশটির সরকার প্রধান হতে চলেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে পরপর তিনবার জার্মানির মত একটা দেশের চ্যান্সেলর হতে যাওয়া কে এই অ্যাঙ্গেলা মর্কেল? কেন তিনি দেশটির মানুষের কাছে এতো জনপ্রিয়? কেন তিনি আজ ইউরোপ ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বনন্দিত নেতা?
অ্যাঙ্গেলা মর্কেলের রাজনীতিতে আগমন একরকম কাকতালীয়ভাবেই! তখন তার বয়স ৩৪। তৎকালীন পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রীর (লোথার ডে-মেসিয়ার) রাজনৈতিক সচিব হিসেবে রাজনীতির মঞ্চে পদার্পণ করেন মর্কেল। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতনের মাধ্যমে দেশটির পূর্ব-পশ্চিম এক হওয়ার পর বৃহত্তর জার্মানির প্রথম নির্বাচনে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তৎকালীন চ্যান্সেলর হেলমুট কোল মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে মর্কেলকে যুব ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। অর্থাৎ ৩৫ বছর বয়স থেকেই দায়িত্বশীল রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় মর্কেলের।
তারপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি এই বিস্ময় মানবীকে! ধাপে ধাপে গড়েছেন সাফল্যের সিঁড়ি। উজ্জ্বল করেছেন নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার।
মর্কেলের ভাগ্য খুলে যায় ১৯৯৮ সালে। সেবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন চ্যান্সেলর হেলমুট কোল তার প্রতিপক্ষ সোশ্যাল ডেমোক্রেট প্রার্থী গেরহার্ড স্রোডারের কাছে পরাজিত হন। একই সঙ্গে চাঁদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ভরাডুবির মুখে পড়ে তার দল সিডিইউ। তখন দলের অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসেন মর্কেল। একধাপে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। জার্মানির ইতিহাসে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে কোনো দলের প্রধান হওয়ার উদাহরণও একমাত্র এটাই।
সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই প্রাথমিকভাবে ‘একটি পুরুষ-শাসিত সমাজে’ ক্যাথলিক কট্টরপন্থিদের সঙ্গে সিডিইউর উদারপন্থিদের একত্রিকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। খুব সহজেই এই পদক্ষেপে সফল হন তিনি।
সকলপক্ষকে একত্রিত করার সুফল হিসেবে ২০০৫ সাল থেকে দুই দফায় জার্মান চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়ে দক্ষ ম্যানেজারের মতোই দেশ শাসন করে চলেছেন মর্কেল।
প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সুনিপুণ কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে মর্কেলকে। জার্মানির ‘ইউরো-সংশয়বাদী’দের তিনি বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করেছেন। অন্যদিকে, ‘ইউরোপ-বান্ধব’দেরও খুশি করেছেন দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও সংস্কার উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করে।
অ্যাঙ্গেলা মর্কেলের রাজনৈতিক জীবনে কিছু নেতিবাচক অধ্যায় থাকলেও তার সাফল্য সবার কাছেই বিস্ময়ের। একজন নারী হিসেবে ৩৪ বছর বয়সে রাজনীতিতে আসা। পূর্ব-জার্মানির সমাজতান্ত্রিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা একজন পদার্থ বিজ্ঞানী বৃহত্তর জার্মানির মত ইউরোপের এক ধনতান্ত্রিক দেশের সরকার প্রধান পদে দুইবার নির্বাচিত হয়ে তৃতীয়বারের মতোও নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করা, কিভাবে এটা সম্ভব? সেটা সত্যিই সবাইকে ভাবিয়ে তোলে!
তবে বিশ্লেষকদের মতে, মর্কেল যেমন সুনিপুণ কৌশলী তেমনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষকও! স্বল্পভাষী মর্কেল যেটুকু কথা বলেন ঠিক যেন জনগণের কথারই প্রতিফলন হয়। তিনি যে কথাটি বলেন সে কথাটি বাস্তবায়ন হতেও বেশি সময় লাগে না।
তার ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অতি সাম্প্রতিক তিনটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, ২০১১ সনে জাপানের ফুকুশিমা দুর্যোগের ঘটনার পর বেশিরভাগ জার্মান নাগরিক চেয়েছিলেন যেন দেশটির সকল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। অ্যাঙ্গেলা মর্কেলও দ্বিমত পোষণ না করে জনমতকে প্রাধান্য দিলেন ।
নিজে পারমাণবিক শক্তি নীতির একজন প্রভাবশালী প্রবক্তা হলেও নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করায় তার জনসমর্থন বেড়ে গেছে হু হু করে।
দ্বিতীয়ত, ইউরো কঠোরতার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মর্কেল। সাম্প্রতিককালের ইউরো সংকট মোকাবেলায় জোরালো ভূমিকা রাখতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি। একদিকে যেমন ইউরো মুদ্রায় ধস নামেনি, অন্যদিকে জার্মান ভোটারদেরও খুশি করতে পেরেছেন তিনি। গ্রিস, ইতালি ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক সমস্যায় বিশাল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিয়ে স্বদেশে এবং পুরো ইউরোপজুড়ে বাহবা কুড়িয়েছেন তিনি।
তৃতীয়ত, সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অ্যাঙ্গেলা মর্কেল নিজের দেশের ভোটারদের সমালোচনায় বেশ বিপাকে পড়েন। মার্কিন ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ (এনএসএ) জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানুষজনের ওপর নজরদারি করেছে বলে প্রকাশ পায়। এছাড়া, জার্মানির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা অনেক বছর ধরেই মার্কিনিদের গোয়েন্দাগিরির কথা জানতো, এমনকি সহযোগিতাও করে আসছিল বলে খবর প্রকাশ হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে মর্কেলবিরোধী দল ও মিডিয়াগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও বেশ কিছুদিন নিশ্চুপ ছিলেন মর্কেল। জনগণের মতামত পর্যবেক্ষণ শেষে জার্মান টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মার্কিন গোয়েন্দাদের কার্যকলাপ হয়ত জার্মান আইনকে লঙ্ঘন করেছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে বলে আশা করছি।
মর্কেলের ইতিবাচক দিক হলো এমনই। কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে তিনি পরিস্থিতি অনেক ঠাণ্ডা মাথায় পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন। তারপর অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মতামতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
তবে অ্যাঙ্গেলা মর্কেল ব্যক্তিগত দুর্বলতা সম্পর্কেও অবগত। যেমন সোশ্যাল ডেমোক্রেট দল থেকে মনোনীত চ্যান্সেলর প্রার্থী পিয়ার স্টাইনব্রুকের মত ভালো বক্তা নন তিনি, এমনকি অর্থনীতিবিদও নন। তবু তিনি আসন্ন নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হতে চলেছেন। সর্বশেষ একটি জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, বিস্ময় মানবী অ্যাঙ্গেলা মর্কেলের জয় প্রায় নিশ্চিত।
লেখক পরিচিতি: মীর মোনাজ হক, জার্মানি থেকে প্রকাশিত এশিয়া টুডে পত্রিকার সম্পাদক, ইমেইল-editor@asiatoday.fr
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৩
এইচএ/আরআই/আরআইএস