যে সব পাঠক ভারতে বেড়াতে আসতে চান কিন্তু সময়ের অভাবে যেতে পারছেন না তাদের জন্য বাঙলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর চোখ দিয়ে ভারতের বিখ্যাত জায়গাগুলোর চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন আমাদের কলকাতা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ভাষ্কর সরদার। তারই চতুর্থ কিস্তি এবার তুলে ধরা হল-
হাতে সময় অল্প।
এই ইতিহাস ভারতের সমাজ জীবন, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির এক বিরলতম সাক্ষী। বলা যায় ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান এই তিনটি দেশের জন্মের ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই জায়গার সঙ্গে।
রেশমের জন্য বিখ্যাত মুর্শিদাবাদের ইতিহাস কিন্তু সেখানকার রেশমের মত মোলায়েম নয়। ইতিহাসের মঞ্চে যাবতীয় নাট্য উপাদান ঘিরে আছে গোটা মুর্শিদাবাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
আছে নবাবদের নবাবীর কাহিনী। আছে প্রেম, যুদ্ধ, দেশপ্রেম, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক চক্রান্ত, বেইমানি, আত্মত্যাগ এবং বন্ধুত্বের উপাখ্যান। এবারের আমার গন্তব্য সেই ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
কলকাতা থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জেলা। প্রধান শহর বহরমপুর। হুগলী আর ভাগীরথী নদী জড়িয়ে রেখেছে এই জেলাকে। কলকাতা থেকে রেলে চেপে ৪ ঘণ্টার কাছাকাছি সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় মুর্শিদাবাদ। এছাড়া আছে সড়ক পথ। বাসে কিংবা গাড়িতেও খুব সহজেই মুর্শিদাবাদ পৈছান যায়।
প্রাচীন নথি ঘাঁটলে ১৮০০ শতকে ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে মুর্শিদাবাদ বলে একটি কৃষি ক্ষেত্র এবং রেশম উৎপাদক জায়গার কথা জানা যায়। এর আগে ১৬০০ শতকে মোঘল সম্রাট আকবর এই অঞ্চলটিকে নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন।
রেশম ও হাতির দাঁতের শিল্প ছাড়াও এই অঞ্চল সোনা ও রুপার জড়ির কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল।
হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ে। আগে থেকে করিয়ে রাখা রিজার্ভেশন টিকিট নিয়ে হাজির হলাম শিয়ালদা স্টেশনে। নিয়ম মত নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা আগেই। তখন সবেই সন্ধ্যায় নেমেছে কলকাতায়।
প্রত্যেকটি স্টেশনের একটি অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য থাকে। শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনের ভিতর থেকে শত শত মানুষ নেমে আসে, তারপর তারা ছড়িয়ে পড়ে শহরের নানা প্রান্তে। মিশে যায় বৃহত্তর নাগরিকদের ভিড়ে ঠিক যেন খরস্রোতা নদী সমতলে এসে মিশে যাচ্ছে সাগরের সঙ্গে।
আবার একদল লোক দখল করছে খালি হয়ে যাওয়া রেলের কামড়াগুলিকে। তারা কেউ ফিরছে বাড়ি, কেঊ অন্য কোন কাজে। কেউ হয়তো বা পাড়ি জমাচ্ছে আমারই মত কিছু অজানা অচেনা মানুষ তাদের ইতিহাসের সন্ধানে।
রিজার্ভেশনের তালিকা মিলিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। একমাত্র সঙ্গী আমার পিঠের ব্যাগটি। ওটাই আমার এই কয়েকদিনের সংসার। ট্রেনের ভিতরে তখন সিট খুঁজে নিয়ে বসার তাড়া-হুড়া। যাত্রীদের গুঞ্জন, ফেরিওলাদের হাঁক ডাক। অনেকেই বেড়াতে চলেছেন নবাবের শহরে। আর নিত্যযাত্রীরা তো আছেনই।
ধীরে ধীরে স্টেশন ছাড়ল ট্রেন। জানলার বাইরে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল ফেরিওলাদের শব্দ, কুলিদের দরাদরি, প্লাটফর্মের চিৎকার চেঁচামিচি। জানলার বাইরে দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছুটন্ত আলোয় মোড়া শহর কলকাতা।
গতি বাড়ার সাথে সাথে কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলে গেল জানলার বাইরের চেনা ছবিটা। ঝকঝকে আলোয় মোড়া শহরের বদলে চোখে ধরা দিতে লাগলো শহরতলির চেহারা। কিছুটা আটপৌরে নাগরিক রূপ। আলো আঁধারির এক জলছবি।
এরপর দেখা গেল রেল লাইনের পাশে জাতীয় সড়ক আর তাতে ছুটে চলা গাড়ির অন্ধকারে বুক চেরা হেড লাইট। তার আশে পাশে কিংবা একটু দূরে কল-কারখানার আলো, ছোট ছোট দোকানপাট, বাজার, রেলের স্টেশন। কিছু চেনা কিছু অচেনা ছবি।
সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকলো জানলার বাইরের অন্ধকার। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে বিপরীত দিকে ছুটে চলা দ্রুত গতির অন্য কোন ট্রেন। একটা হঠাৎ আলোর ঝলকানি। গভীর অন্ধকারে মাঝে চোখে পড়ে ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামের ঘরগুলির ভিতর থেকে দূর আকাশের নক্ষত্রের মত জ্বলতে থাকা বিদ্যুতের আলো।
সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রাম গুলির আলোও কমে আসে। ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে গোটা প্রকৃতিকে। এ এক অন্য সৌন্দর্য। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে ছোট ছোট আলো যেন জীবনের সন্ধান দেয়। ঠিক যেন গভীর রাতের আকাশ প্রদীপ।
ট্রেনের ভিতরে সহযাত্রীরা কেউ খবরের কাগজে ডুব দিয়েছেন কেউবা কানে হেড ফোন গুঁজে প্রিয় সুরের সাগরে ঢেউ এর দোলায় দুলছেন।
পাশের সহযাত্রীর অনুরোধে তার দেওয়া চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিলাম। যদিও ট্রেনের কামড়ার ভিতর অপরিচিত কারোর কাছ থেকে কোনকিছু খাদ্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বড় বড় করে নিষেধ করা আছে। তবুও মনে হোল যখন পথিক হয়েছি তখন পথকে বিশ্বাস করতে বাঁধা কোথায়!
আমার প্রথম গন্তব্য বহরমপুর। সেখানেই রাত্রিবাস, পরের দিন সকাল থেকে ঘুরে দেখা নবাবদের শহর মুর্শিদাবাদ। বহরমপুরের কিছুটা আগেই ট্রেন পেড়িয়ে গেল পলাশী স্টেশন। পলাশী, ঠিক এই জায়গাটি থেকেই শুরু হয়েছিল বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস।
১৭৫৭ এর ২৩ জুন, সেদিনের শেষ লড়াইতে লর্ড ক্লাইভের সেনার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ–উদ-দৌলা। তার সেনাপতি মীর জাফর যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। সেদিনের সেই রক্তক্ষয়ী লড়াই ও বিশ্বাসঘাতকতার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সিরাজ। শুরু হয়েছিল বাংলার বুকে ইংরেজদের শাসান। বনিকের মানদণ্ড পরিণত হয়েছিল রাজদণ্ডে।
বেইমানি করেছিল মীর জাফর আর জগৎ শেঠের দলবল। এরপরেই শুরু হয় বাংলায় ইংরেজ শাসন।
মুর্শিদাবাদ ছিল ব্রিটিশ শাসনের আগে সুবে বাংলার রাজধানী। ১৭০৪ সালে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন। এর আগে এই এলাকার আদি বাসিন্দা ছিলেন জগৎ শেঠ এবং তার পরিবার।
কিছুক্ষণ বাদেই ট্রেন বহরমপুর স্টেশনে প্রবেশ করল। বেশ বড় স্টেশন। আলোয় ঝলমলে। অনেক দোকান-পাট। স্টেশনের আশেপাশে অনেক গুলি হোটেল আছে। স্টেশন থেকে একটু দূরে বহরমপুর বাস স্ট্যান্ডের কাছে আছে বেশ কতগুলি হোটেল । এর মধ্যেই একটিকে পছন্দ করে ঢুকে গেলেই হোল। তবে আগে থকে বুকিং করে রাখলে সুবিধে হবে। অ
নেক হোটেলের সঙ্গেই আছে রেস্তরা। আর ইচ্ছে হলে বাইরের যেকোনো হোটেল থেকে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করা যেতেই পারে। চাহলেই পাওয়া যাবে নবাবী বিরিয়ানি কিংবা মোঘলাই খানাপিনা।
মুর্শিদাবাদ ঘোরার জন্য যদি একটি গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া যায় তবে সব থেকে সুবিধা হয়। চাইলেই আপনার জন্য ব্যবস্থা হয়ে যাবে গাড়ি। আর সেই গাড়িতে চেপেই আপনি ঘুরে বেড়াতে পারবেন গোটা মুর্শিদাবাদ।
তবে যদি আপনি মেজাজে নবাব হয়ে থাকেন তবে মুর্শিদাবাদে পৌঁছে ভাড়া নিতে পারেন একটি টাঙ্গা। ঘোড়ায়টানা এই গাড়িতে চড়ে আপনি নবাবি চালে ঘুরে দেখতে পারেন নবাবদের শহর।
১৯০০ শতকের সময় মুসলিম উলেমারা প্রথম ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এই অঞ্চল থেকেই আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তী বিভিন্ন সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে মুর্শিদাবাদে পা রাখেন গান্ধীজী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, চিত্তরঞ্জন দাস, সূর্য সেন, কাজী নজরুলসহ আরও আনেকে।
মুর্শিদাবাদের একদিকে মালদা জেলা, অন্যদিকে ঝাড়খণ্ড রাজ্য, আপর দিকে আছে নদীয়া ও বীরভূম জেলা। আর এক দিকে বাংলাদেশের রাজশাহীর সীমা ছুঁইয়ে আছে নবাবদের স্মতি বিজড়িত এই শহর।
পরিকল্পনা হয়েছিল মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান থেকে রাজশাহী পর্যন্ত জলপথ চালু করার। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। আজও চালু হয়নি ধুলিয়ান–রাজশাহী জলপথ।
প্রাতঃরাশের পর বেড়িয়ে পড়লাম মুর্শিদাবাদ দেখতে। আমার সফর সঙ্গী বলতে একটি ভাড়া করা গাড়ি ও তার চালক। প্রথম গন্তব্য হাজার দুয়ারি। আনুমানিক ১৮৩৭ সালে এই বিরাট প্রসাদ তৈরি করেন নবাব নাজিম হুমায়ুন শাহ।
এই প্রাসাদে আছে ১০০০টি দরজা। যেগুলির মধ্যে ৯০০টি আসল আর ১০০টি দরজার প্রতিরূপ। খুব কাছে থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই কোনটি আসল আর কোনটি নকল।
ইতালি ধারায় তৈরি ৪১ একর জোড়া এই প্রাসাদে ১১৪টি ঘর আছে। এছাড়া আছে ৮টি সভা ঘর।
গোটা প্রাসাদটিকে নবাবদের ব্যবহার করা নানা রকম জিনিষ দিয়ে সাজান রয়েছে। আছে অদ্ভুত সেই আয়না যার সামনে দাঁড়ান মানুষটির প্রতিচ্ছবি কোন ভাবেই দেখা যায় না। বাকি সব কিছু একই রকমভাবে দৃশ্যমান থাকে।
আছে হাতির পিঠে নবাবের বসবার জন্য রুপার হাওদা আর তাতে সুদৃশ্য সোনার জড়ির কাজের নরম রেশমের চাদর। আছে নবাবদের ব্যবহার করা বিভিন্ন অস্ত্র। তার আকার এবং ওজন অবাক করার মত।
এর থেকে সেই সময়ের যোদ্ধাদের শারীরিক ক্ষমতার আন্দাজ পাওয়া যায়। দেখা যাবে নবাবদের অস্ত্রাগার। যেখানে আছে ২৭০০ রকমের যুদ্ধের অস্ত্র। আছে নবাবদের ব্যবহার করা বাসন। যেগুলি নানা দেশ থেকে আমদানি করা।
চক্রান্ত নবাবদের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীকভাবে জড়িত। আর সেই জন্যই অভূতপূর্ব নিরাপত্তা বলয় ঘিরে থাকত নবাব এবং তার পরিবারের লোকজনদের।
নবাবের খাবার বেশ কয়েক রকম পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে হাজির করা হোতো। এই পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে খাবার রাখা হতো একটি বিশেষ পাত্রে। যদি খাবারে বিষের সামান্য উপস্থিতি থাকে তবে সেই পাত্র তার রঙ পরিবর্তন করে নীল রঙে পরিণত হতো।
এছাড়াও আছে মহামূল্যবান নানা রকম জিনিষ। তবে ভালো করে না দেখলে পরে আপসোস করতে হবে। তাই একটু বেশি সময় নিয়ে আসবেন। একটা দিন হাজার দুয়ারীর জন্য বরাদ্দ রাখতে পারেন।
নবাব পরিবারের ফিটন গাড়িটি দেখতে ভুলবেন না।
এছাড়া আছে বিরাট পাঠাগার। তাতে নানা ধরনের প্রাচীন বই-পত্র, পুঁথির সম্ভার। তবে পাঠাগারটি সাধারণের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না।
এর পর দেখে নেবেন হাজার দুয়ারীতে নবাবদের সভা ঘর। যেখানে বসে রাজ্য চালাতেন নবাব আলিবর্দি খান এবং তার নাতি নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা।
এখানে দেখতে পাবেন নবাবদের সিংহাসন। বেগমদের পর্দা ঘেরা বসার জায়গা। একটু চোখ খুলে রাখলে দেখতে পাবেন সভাঘরের অভূতপূর্ব নিরাপত্তা। আজকের ক্লোজ সার্কিট টিভির মতোই গোপন ঘুলঘুলি দিয়ে সে সময় নজর রাখতো কিছু সদা-সতর্ক চোখ। নবাবদের নিরাপত্তা বলয় আজকের নেতা মন্ত্রীদের নিরাপত্তা বলয়ের থেকে কম কিছু ছিল না।
হাজার দুয়ারীর সিঁড়ি থকে নেমে এলেই চোখে পড়বে ইমামরাড়া। নবাব নাজিম মনসুর আলি খান এটি নির্মাণ করেন। আগুনে পুড়ে যাবার পর সিরাজ-উদ-দৈলা এটিকে আবার পুণঃর্নির্মাণ করেন। এটি পশ্চিমবঙ্গের এবং সম্ভবত ভারতের সব থেকে বড় ইমামবাড়া।
একদিকে ঐতিহাসিক কাল থেকে বইতে থাকা গঙ্গা। যার বুকের উপর দিয়ে পার হয়ে গেছে কত জানা না জানা সময়ের বলা না বলা ঘটনা। তার সব হয়তো ধরাও পড়েনি ইতিহাসের চোখে।
কত দিনের কত ঘটনা তলিয়ে গেছে এই বয়ে চলা নদীর গভীরে ঠিক যেমন ঢাকা থেকে আনা এক বিশাল কামান তলিয়ে গিয়েছিল নদীর জলের তলায়।
হাজার দুয়ারী আর ইমামবাড়ার মাঝে আছে “মদিনা” মসজিদ। সুন্দর পাথরের কারুকার্য করা এই মসজিদ আসল মদিনা মসজিদের অনুকরণে তৈরি।
এর মাঝে আছে বাচ্চাবলি কামান। শোনা যায় এই কামানটিকে পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করার সময়ই এর বিরাট শব্দে বেশ কয়েকটি গ্রামের গর্ভবতী মহিলাদের সন্তান গর্ভেই মৃত্যু বরণ করেন। এর পরেই কামানটির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শোনা যায় এক একবার গোলা নিক্ষেপ করতে ১৮ কেজি বারুদের দরকার হতো এই কামানে।
হাজার দুয়ারীর সিঁড়ি আর মাঠে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন আনেকে। গোটা এলাকা জুড়ে আছে সুন্দর বাগান। একটু চা নিয়ে গলা জুড়িয়ে নিলাম। মন জুড়িয়ে গেল।
একটি চায়ের কাপ মাটিতে ফেলতে দিচ্ছেন না সেখানকার চা বিক্রেতারা। দরকার হলে নিজেরা কুড়িয়ে নোংরা ফেলার জায়গায় সেগুলিকে ফেলে দিচ্ছেন। এরা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে নবাবদের স্মৃতি বিজড়িত জায়গাকে।
একটু দুরেই ওয়াসিফ মঞ্জিল। সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরের এই প্রাসাদ বানিয়েছিলেন নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা। অপূর্ব সুন্দর পাথরের মূর্তি দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে এই প্রাসাদে।
এর পর গাড়ি এগিয়ে চললো মুর্শিদাবাদ স্টেশনের রাস্তা ধরে।
কিছুটা গিয়ে গাড়ি থামল কাটারা মসজিদে। বিরাট এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ। এখানেই তার সমাধি ক্ষেত্রটিও অবস্থিত।
এরপর গাড়ি গিয়ে থামল সামান্য কিছুটা দূরে। গাড়ির মিটার জানান দিল দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। এখানে আছে জাহান কোশা। একটি বিরাট কামান। ১৭.৫ ফুটের এই কামান ঢাকার জর্নাধন কর্মকার নামে এক কারিগর তৈরি করেছিলেন। এর পাশেই কাদেম শেরিফ।
হাজার দুয়ারীর কিছুটা দূরে আছে জাফরগঞ্জ। এখানেই আছে মীর জাফরের সমাধি। এখানে যেতেই চোখে পড়বে নিমক হারাম দেউরি। বলা হয় এই জায়গায় হত্যা করা হয়েছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে।
হোটেলে ফেরার পথে মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম নাবাবের সময়ের কথা। হাতে হাজার দুয়ারীর সামনের দোকান থেকে কেনা ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস’। হোটেলে ফিরে বিশ্রাম। কি স্বপ্ন দেখেছিলাম মনে নেই তবে কেন জানি বার বার চোখে ভেসে আসছিল হাজার দুয়ারীর রাজ সভার পাশের দেওয়ালে রাখা বিরাট তরবারি হাতে সিরাজের ছবিটা। নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব।
পরের দিন ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে হাজির নজিমুল। নাজিমুল আমার গাড়ির চালকই নয় আমার গাইডও। আবারও ভেসে পড়লাম ইতিহাসের ভেলায়। এবারের প্রধান গন্তব্য ভাগীরথীর আপর পাড়।
ভাগীরথীর অপর পাড়ে খোসবাগ। ৭.৬৫ একর এই জায়গাতেই শুয়ে আছেন নবাব আলিবর্দি খাঁ। দাদুর প্রিয় ছিলেন নাতি সিরাজ। তাই তার শেষ শয্যাটিকেও রাখা আছে দাদুর ঠিক পাশেই। এইখানে সমাধিস্থ হয়ে আছেন সিরাজের বেগম লুৎফুন্নেসা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
লুৎফুন্নেসার সমাধিটি একটু আড়ালে, গোলাপ বাগান দিয়ে ঘেরা। দেখে মনে হল যেন বেগম সাহেবা গোলাপের পর্দার আড়ালে রেখেছেন নিজেকে। ঠিক যে ভাবে পর্দার আড়ালে থেকেও খুবই প্রাসঙ্গিক ছিলেন তৎকালীন রাজনীতিতে।
খোস বাগে এসে মনে হল যুগ যুগ ধরে রাজনীতি বড় রক্ত পিপাসী। দেশে দেশে যুগে যুগে ক্ষমতা দখলের লড়াই যেন জমা হয়ে আছে ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে। আর সেই লড়াইয়ের ময়দান থেকে তরবারির রক্ত যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে ইতিহাসের পাতার প্রতিটি শব্দকে।
হিংসা মানুষের ষড় রিপুর একটি। এর ফলেই যুদ্ধ। জানিনা সভ্যতার পরিনতির কোন স্তরে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর প্রবৃতির থেকে মুক্ত হবে মানব জাতি।
খোস বাগের মসজিদটির কতগুলি বিশেষত্ব আছে। এই মসজিদে নামাজ পড়তেন সিরাজ-উদ-দৌল্লা। নামাজ পড়ার জায়গা থেকে সরাসরি দেখা যায় সদর দরজা। অর্থাৎ সদর দরজা দিয়ে শত্রু প্রবেশ করলেই নজরে পড়ে যাবে। মনে রাখতে হবে মসজিদ থেকে সদর দরজার মধ্যে আছে আরও বেশ কিছু দরজা। অবাক করা নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
মসজিদটি এমনভাবে তৈরি যাতে খালি গলায় নামাজ পড়া হলেও তা অনুরণিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সংলগ্ন এলাকায়। সে সময় মাইকের ব্যবহার ছিলনা কিন্তু বিঞ্জানকে কাজে লাগিয়ে এই পদ্ধতি আমাকে বাকরুদ্ধ করেছে। এরপর হাজির হলাম নাসিপুর প্যালেস, সেখান থেকে কাঠ গোলা, জগৎ শেঠের বাড়ি।
আমার গাড়ির চালক নাজিমুলের কথা মত হাজির হলাম ফুটি মসজিদে। এক অদ্ভুত শিল্প শৈলি। যা আগে দেখিনি। প্রচলিত আছে, নবাব সরফরজ খান এক রাতের মধ্যে এই গোটা নির্মাণ কাজটি করেছিলেন। কিন্তু মসজিদটি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
এমন অনেক কিছু আজও খুঁজে পাওয়া যায় যেটা হয়ত প্রামাণ্য ইতিহাস নয়। হয়ত বা ইতিহাসের সাথে সাথে মিলে মিশে আছে লোককথা। কিন্তু এইগুলির কোন কিছুকেই উড়িয়ে দেওয় যায়না, প্রশ্ন করা যেতেই পারে কিন্তু অবিশ্বাস করা যায় না।
এবার হাজির হলাম মতিঝিলে। অশ্ব ক্ষুরাকৃতি এই হ্রদে মুক্তাচাষ করতেন নয়াজশাহ মহম্মদ। ইনি ঐতিহাসিক চরিত্র ঘোসিটি বেগমের স্বামী। এখানেই সমাধিতে আছেন নয়াজশাহ মহম্মদ, সিরাজ-উদ-দৌল্লার ভাই ইক্রাম-উদ-দৌল্লা, তার শিক্ষক এবং তার পরিচারিকা।
বেশ কিছু লোককথা আছে এই ঘোসিটি বেগমকে ঘিরে। ঘোসিটি বেগম সিরাজের মাসি। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সিরাজের বিপরিতে। শোনা যায় নবাবের অন্দর মহল এবং বর্হিমহলের রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে ছিলেন ঘোসিটি বেগম।
মতিঝিলের পাশে নয়াজশাহ মহম্মদ-এর বানানো একটি ছোট মসজিদ আছে। আর আছে একটি গুপ্ত কক্ষ। এই কক্ষটিকে ঘিরেও আছে নানা লোককথা। যদিও তার মধ্যে ইতিহাসের কোন প্রমাণ নেই।
বলা হয় এই কক্ষে নাকি গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিলেন ঘোসিটি বেগম। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে কামান দেগেও ভাঙা যায়নি দরজা বিহীন কক্ষের দেওয়াল।
নবাবদের ইতিহাস আজও ভীষণভাবে জীবন্ত। মনে হয় এখনও অনেক কিছুই যেন অনাবিস্কৃত অবস্থায় ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক।
সময় পেলে ঘুরে আসতে পারেন কিরিটেস্বরি মন্দির। পুরানো মন্দির গুলি ভগ্ন প্রায়। তৈরি হয়েছে নতুন মন্দির। বিশেষ বিশেষ দিনে মন্দির চত্বরে বসে ছোট খাটো মেলা। তবে মুর্শিদাবাদ মিউজিয়ামটি দেখতে ভুলে যাবেন না। আর স্মৃতি হিসেবে সঙ্গে নিতে পারেন ঘর সাজাবার পেতলের নানা জিনিষ। এগুলিকে বলা হয় খাগড়া শিল্প।
এই খাগড়া শিল্পের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই শিল্প ছিল তখনকার আদিবাসীদের একান্ত নিজস্ব কলা। অতি গোপনীয় ছিল তার নির্মাণ শৈলী। তার কথা অন্য একদিন হাজির করব।
এছাড়াও উপহার হিসেবে নিতে পারেন হাতির দাঁতের বিভিন্ন জিনিষ। সঙ্গে রেশম সুতোর সিল্ক শাড়ি তো আছেই।
নাজমুলের অনুরোধে এক বিশেষ ধরনের মিষ্টি খেতেই হোল। নাম ছানাপোড়া। এমন রসাল মিষ্টি আগে খাইনি। দেখতে কিছুটা লেডিগেনির মত। অপূর্ব স্বাদ। লোভ সামলাতেতে না পেরে মুখু পুরে দিলাম বেশ কয়েকটা।
কলকাতায় ফিরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি উত্তর থেকে দক্ষিণের নামি দামি সব দোকান। কিন্তু সেই ছানাপোড়া আর কোথাও পাইনি। একেই বোধ হয় বলে ‘মধুরেন সমাপেয়’।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩
ভিএস/এসএস/এসআরএস