ঢাকা: দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক তিনি। মরে যাবেন তবু মাথা নত করবেন না-দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার আগে এ পণই করেছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ও তার মিত্রদের পরাজয় হয়। ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর অবসান হয় যুদ্ধের। কিন্তু ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ কথা বিশ্বাসই হয়নি হিরো ওনোদার। ৯১ বছর বয়সে ১৭ জানুয়ারি জীবনাবসান হয় জাপানিদের এ ‘হিরো’র।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও তিন দশক তিনি জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন গ্রেফতার এড়াতে। আত্মসমপর্ণের আগে বেশ কয়েকবার ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে হেলিকপ্টার থেকে ‘যুদ্ধ শেষ হয়েছে’ এমন প্রচারপত্র ফেলা দেওয়া বা তার পরিবারের স্বজনদের দিয়ে মাইকিং করেও তাকে বোঝানো সম্ভব হয়নি।
১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফিলিপাইনের একটি জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো তার বিশ্বাস হয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন তিন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের কাছে থাকা রাষ্ট্রের দেওয়া সামুরাই অস্ত্র সমর্পণ করেন।
ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করছেন ওনোদা
১৯৪৪ সালে ওনোদাকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে ফিলিপাইনের পশ্চিমাঞ্চলের ছোট দ্বীপ লুবাংয়ে পাঠানো হয়।
যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কাছে জাপানি বাহিনীর পরাজয় ঘটে। ওই অঞ্চল থাকা জাপানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে, অনেক সৈন্য প্রত্যাহার করে জাপান। কিন্তু মার্কিন বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ পালিয়ে যান লেফটেন্যান্ট ওনোদা।
বিভিন্ন সময় নিজের সঙ্গীদের হারিয়ে ফেলেন তিনি। দ্বীপে স্থানীয়দের খাবার চুরি করে খেতেন তিনি। বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদও হয়েছে। কমপক্ষে ৩০ জন স্থানীয়কে হত্যা করেছেন তিনি।
অবশেষে তার সাবেক কমান্ডিং অফিসার লুবাংয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই কমান্ডার ওনোদাকে বোঝান, যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এরপরেই তিনি জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে সম্মত হন।
এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক জাপানি সৈন্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল গেরিলা যুদ্ধ চালানোর, মরার নয়। ’
১৯৭৪ সালের ১২ মার্চ জাপানে ফিরেন ওনোদা। টোকিও বিমানবন্দরে তাকে গ্রহণ করতে সরকারি কর্মকর্তাসহ জনতার ভিড়
দেশের প্রতি এ অানুগত্যের কারণে জাপানিদের কাছে ‘বীর’ হিসেবে বিবেচিত তিনি। প্রত্যাবর্তনের পর জাপানে আমূল পরিবর্তন দেখতে পান তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের দর্শন ও ১৯৭৪ সালের জাপানের দর্শনের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে জাপান ছেড়ে ব্রাজিলে যান তিনি। ১৯৭৬ সালে বিয়ে করেন তিনি।
১৯৮১ সালে ব্রাজিলে ওনোদা
এবিসিকে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের দর্শন ও আদর্শের মধ্যে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। এ দর্শন আমার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই ব্রাজিলে বসবাসের জন্য চলে গেলাম। ’
১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে তরুণ জাপানিদের টিকে থাকা ও ক্যাম্পিং স্কিল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ‘ওনোদা শিজেন জুকু’ (ওনোদা ন্যাচার স্কুল) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের যাত্রা করেন।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে টোকিওতে আসাহি শিম্বু পত্রিকা অফিসে ওনোদা
৩০ বছর জঙ্গলে জঙ্গলে কাটানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘নো সারেন্ডার: মাই থার্টি-ইয়ার ওয়ার’ নামে একটি বই লিখেন তিনি।
বইয়ে কিছু উক্তি ব্যবহার করেছেন তিনি। ওইসব উক্তিতে তার ব্যক্তিত্ব ও দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। এগুলোর কয়েকটি হচ্ছে:
‘নারীদের সঙ্গে পুরুষের কখনই প্রতিযোগিতা করা উচিত নয়। করলে তারা সবসময়ই হারবেন। কেননা নারীদের ধৈর্য অনেক বেশি। আমার মা এটি বলেছিলেন। তিনি সঠিক ছিলেন। ’
‘জীবন ন্যায্য নয় এবং মানুষ সমান নন। কেউ কেউ অন্যান্যদের চেয়ে ভালো খান। ’
‘একবার গরম মিসো স্যুপ পান করতে গিয়ে জিহ্বা পুড়ে ফেলেন, তাহলে আপনি ঠাণ্ডা সুশিতেও ফুঁ মারবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে জাপান সরকারের বর্তমান আচরণ ঠিক এরকমই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
সম্পাদনা: শরিফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর