ঢাকা: রঙধনুর সাতরঙে রঙিন আর আকাশসম বিশাল স্বপ্ন নিয়ে বধূ সেজে গিয়েছিলেন স্বামীর ঘরে। মা-বাবার মমতাময়ী জগৎ ছেড়ে পরের ঘরে পা রাখতে কষ্ট হলেও এই ঘরকেই নিজের মতো করে সাজিয়ে ভুলতে চেয়েছিলেন মা-বাবার চোখের আড়াল হওয়ার দুঃখ।
বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মা-বাবার চোখে অশ্রু স্রোত বইয়ে প্রায় ৮ বছর আগে ঝাড়খণ্ডের কোদেরমা জেলার তরুণী পুণম বধূ সেজে পার্শ্ববর্তী জেলা হাজারিবাগের সুদামা গিরির ঘরে পা রাখেন। কিন্তু মা-বাবার ঘর ছেড়ে স্বামী ঘরে নয়, যেন ভয়ংকর মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দেন পুণম। বিয়ের পরই তার ওপর যৌতুকের দাবিতে শুরু হয় স্বামী-শাশুড়ীর নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের নির্মমতা এতো বেশি হতো যে, মাঝে মধ্যে পাড়া-পড়শীরা ছুটে যেতেন পুণমের ঘরের পাশে। কিন্তু তার স্বামী-শাশুড়ীর কড়া ধমকে কেউ সামনে এগোতে চাইতেন না। তবু থামতো না নির্যাতন। প্রায় প্রতি মাসে পুণমকে বাবার বাড়িতে পাঠানো হতো নতুন করে যৌতুকের টাকা আনার জন্য। পুণমের চোখের অশ্রু দেখে বাবা বুঝতেন, মেয়ে কী জন্য এসেছে। পুণম ধৈর্য্য ধরতেন। ভাবতেন, একদিন না একদিন স্বামী-শাশুড়ীর বোধোদয় হবে। এজন্য স্বামী-শাশুড়ীর দাবি মতো দীর্ঘ আট বছর বাবার ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের অর্থ যৌতুক হিসেবে দিতে থাকেন স্বামী-শাশুড়ীকে। সংসারে সুখ ফেরানোর আশায় দুই সন্তানেরও জন্ম দেন। কিন্তু কিছুতেই থামেন না যৌতুকলোভী স্বামী-শাশুড়ী। এক পর্যায়ে তাদের সন্তুষ্ট রাখতে যৌতুক হিসেবে নিজের হৃদস্পন্দন ধরে রাখা কিডনিও দিয়ে দেন পুণম। তবে সুখ ফেরানোর আশায় গুড়েবালি। অমানুষিক নির্যাতন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় তিনি নিজেই নিষ্ঠুর পৃথিবী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আগুন ধরিয়ে দেন শরীরে। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করার পর মঙ্গলবার না ফেরার দেশে চলে যান পুণম।
পুণমের মৃত্যুতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে নিকটস্থ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, যৌতুকের দাবিতে গত ক’বছর ধরে পুণমের শাশুড়ী ও স্বামী তাকে নির্মম নির্যাতন করছিলেন। যথাসাধ্য চেষ্টাও করা হচ্ছিল তাদের যৌতুকের দাবি পূরণের। ছয় মাস আগে পুণমের স্বামী গিরি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গিরির কিডনি অকেজো হয়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা আরেকটি কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। তখন শাশুড়ী পুণমকে বলেন, তিনি যদি গিরিকে কিডনি দান করেন, তবে তাকে আর নির্যাতন করা হবে না এবং তার সঙ্গে এবার থেকে ভালো আচরণ করবেন তারা। এমনকি পুণমের কাছে বাকি ২৫ হাজার রুপি যৌতুকও দাবি করা হবে না বলে অঙ্গীকার করেন শাশুড়ী।
মামলার অভিযোগে পুণমের বাবা বরহান ভারতী বলেন, ২০০৬ সালে বিয়ের পর এক লাখ ৩১ হাজার রুপি যৌতুক নিয়েছে গিরির পরিবার।
বরহান বলেন, যথাসাধ্য যৌতুক পরিশোধের পরও পুণমকে সারাক্ষণ নির্যাতন করতো স্বামীর পরিবার। আর কখনো যৌতুকের জন্য নির্যাতন করা হবে না বলে পুণমকে কিডনি দিতে বাধ্য করা হয়। নির্যাতন সইতে হবে না মনে করে কিডনি দিতে রাজি হলেও থামেনি পুণমের স্বামী-শাশুড়ীর নিষ্ঠুরতা। নির্যাতনে প্রায় সময় তাকে মূর্ছা যেতে হতো।
এমন নির্যাতন থেকে বাঁচতে গত ১৬ এপ্রিল নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন পুণম। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রাঁচির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সপ্তাহখানেক ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মঙ্গলবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান পুণম। বুধবার তার মৃতদেহ হাজারিবাগে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, পুলিশ এখনও পুণমের স্বামী-শাশুড়ীকে আটক করতে পারেনি।
তবে, হাজারিবাগের পুলিশ সুপার মনোজ কৌশিক জানান, ব্যাপারটি আমরা তদন্ত করছি, জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ঘটনায় পুণমের বাবার বাড়ি কোদেরমা ও শ্বশুর বাড়ি হাজারিবাগে শোকের ছায়া নেমেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৪