ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

২০৪৫: মানবেতিহাসের অবসান অথবা অমরত্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১১
২০৪৫: মানবেতিহাসের অবসান অথবা অমরত্ব

মানুষ অমর হচ্ছে। এতোদিনের মরণশীল মানুষ তার জীবন-মৃত্যুর ভাগ্য নিজ হাতে নিতে যাচ্ছে, ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে।

আর হ্যাঁ, এটা মোটেও কল্পকাহিনী নয়; বিজ্ঞানের অত্যাসন্ন ও অমোঘ নিয়ম।

১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫। স্কুলছাত্র রেমন্ড কুরজউইল টিভির একটি গেম শো ‘আই হ্যাভ গট এ সিক্রেট’-এ অংশ নেয়। খেলাটির নিয়ম হচ্ছে, অংশগ্রহণকারীদের এমন কিছু করে দেখাতে হবে যার ভেতর গোপন কিছু আছে। শোয়ের উপস্থাপক স্টিভ অ্যালেন রেমন্ডের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর সে মঞ্চে এসে পিয়ানোয়  সংক্ষিপ্ত সঙ্গীত শুনিয়ে চলে গেল।

বিচারকের প্যানেলে ছিলেন একজন কৌতুক অভিনেতা ও সাবেক মিস আমেরিকা। তারা রেমন্ডের গোপন বিষয়টা ধরে ফেলেন। আর তা হচ্ছে, রেমন্ডের শোনানো ওই সঙ্গীতটির কম্পোজ করেছে একটি কম্পিউটার। এরপর রেমন্ড তার নিজের তৈরি কম্পিউটারটি দেখায়।
 
বলা বাহুল্য, এরপর থেকে রেমন্ড তার জীবনের বাকি দিনগুলোয় তার প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু নিয়েই মেতে আছেন। একটি শিল্পকর্ম সৃষ্টি কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব, তা আত্মপ্রকাশের কাজ। আপনার যদি কোনো আত্মা (সেল্ফ) না থাকত তাহলে কখনোই তা সম্ভব হতো না। তবে ১৭ বছর বয়সী রেমন্ডের নিজের তৈরি কম্পিউটারের পক্ষে মানুষের ভূমিকা পালন করার ওই ব্যাপারটায় জৈব বুদ্ধিমত্তা (মানুষের) ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (মেশিনের) মধ্যে আলো-আঁধারির রেখা ছিল।

১৯৬৫ সালে রেমন্ডের প্রকৃত রহস্যটা কেউই আন্দাজ করতে পারেননি। এমনকি তার মাথায়ও ছিল না, এতোদিন পর্যন্তও না। তবে এখন, ৪৬ বছর পর রেমন্ডের বিশ্বাস, ‘আমরা এমন এক সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যখন কম্পিউটার বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হবে। এমনকি তা মানুষকেও ছাড়িয়ে যাবে। সেই মুহূর্তে মানবিকতা, আমাদের শরীর, মন, সভ্যতা সবকিছুর পুরোপুরি রূপান্তর ঘটে যাবে। ’ রেমন্ড বিশ্বাস করেন, ওই মুহূর্তটা কেবল অপরিহার্যই নয়, অত্যাসন্ন। তার হিসেব মতে, মানব সভ্যতার অবসান হতে আর মাত্র ৩৫ বছর লাগবে।

আমরা যাদের সঙ্গে এই গ্রহটা ভাগাভাগি করতে যাচ্ছি তাদের আচরণ সম্পর্কে অনুমান করা অসম্ভব। তবে এ নিয়ে অনেক তত্ত্ব আছে, হতে পারে আমরা তাদের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে অতিবুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সাইবর্গে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি। হতে পারে, কম্পিউটারের সহায়তায় আমাদের বুদ্ধিমত্তা, শরীরের সামর্থ্যরে সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো আমাদের বুড়ো অবস্থার প্রভাব এড়িয়ে যেতে সহায়ক হবে, জীবনের সীমানা আরও দীর্ঘ হবে। এও হতে পারে, আমাদের সচেতনতা স্ক্যান করে কম্পিউটারে স্থানান্তর করতে পারছি। এর ভেতরে মানুষ সফটওয়্যার হিসেবে চিরস্থায়ী বসবাস করবে। কম্পিউটার হয়তো মানুষকে ধ্বংস করে নিজেই মানবজাতিতে রূপান্ততি হবে। এসব তত্ত্বের মধ্যে একটা মিল আছে, আমাদের প্রজাতির এমনভাবে রূপান্তর ঘটবে যাতে মানবজাতি হিসেবেই পরিচয় আর থাকবে না। আর এ রূপান্তরের একটিই নাম: সিঙ্গুলারিটি (অনন্যতা)। হিউম্যানকাইন্ডের স্থলে মেশিনকাইন্ডের যুগে পদার্পণ ঘটবে ইতিহাসের।

সিঙ্গুলারিটির আলোচনা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো লাগতে পারে। তবে মোটেই তা নয়। এটা ঠিক আবহাওয়া পূর্বাভাসের মতোই ব্যাপার। পৃথিবীর ভবিষ্যতের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।

এ বিষয়ে জানতে লোকজন অনেক টাকাপয়সা খরচ করছে। এ বিষয়ে পড়াশুনা করতে সিঙ্গুলারিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। তিন বছর আগে মহাকাশ সংস্থা নাসার উদ্যোগ এটা সম্ভব হয়। এখানে স্নাতক শিক্ষার্থীরা আন্তবিষয় (ইন্টারডিসিপ্লিনারি) কোর্স অধ্যয়ন করে। গুগল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন পৃষ্ঠপোষক।

১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ আই জে গুড কিছু একটা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘বুদ্ধিমত্তা বিস্ফোরণ’-এর কথা বলেন। তিনি বলেন, একটি অতিবুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মেশিনের কথা বলা যায় যা মানবিক কর্মকা-কে ছাড়িয়ে যাবে।

সিঙ্গুলারিটি শব্দটা নেওয়া হয়েছে জ্যোতিপদার্থবিদ্যা থেকে: এটা মহাশূন্য-সময়ের একটি বিন্দুকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি কৃষ্ণগহ্বরের অভ্যন্তর ভাগ--যেখানে পদার্থবিদ্যার নিয়ম খাটে না। ১৯৯৩ সালে নাসা আয়োজিত একটি সিম্পোজিয়ামে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনীর লেখক ভার্নার ভিনজ ঘোষণা দেন, ‘৩০ বছরের মধ্যে প্রাযুক্তিক উপায় উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা অতিমানবিক বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি করতে সক্ষম হব। এরপরই মানবেতিহাসের অবসান হবে। ’

একইসময়ে রেমন্ড সিঙ্গুলারিটি নিয়ে ভাবছিলেন। এমআইটিতে ছাত্র থাকার সময়ই তিনি প্রকৌশলী ও উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। প্রথমবারের মতো অন্ধদের জন্য ছাপা-থেকে-কথা মেশিন উদ্ভাবন করেন। তার প্রথম খরিদ্দার ছিলেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী স্টিভি ওয়ান্ডার। সঙ্গীত সংশ্লেষকারী মেশিন (মিউজিক সিনথেসাইজার), স্বর পরিচয় মেশিন (স্পিচ রিকগনিশন) থেকে শুরু করে প্রযুক্তির বহু ক্ষেত্রের পথিকৃৎ। ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন তাকে প্রযুক্তিতে জাতীয় পদক দেন। তার নামেই ৩৯টি পেটেন্ট রয়েছে।

গত বিশ বছর রেমন্ড কুরজউইল তার চিন্তা প্রকাশ করে আসছেন। সর্বশেষ ২০০৫-এ ‘দি সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার’ বইটি প্রকাশের পর তা বেস্ট সেলারের জায়গা দখল করে নেয়। বিল গেটস ফিউচারিস্ট রেমন্ড সম্পর্কে বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যত অনুমান করতে পারা সবচেয়ে সেরা ব্যক্তি। ’

সিঙ্গুলারিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্যানফ্রান্সিসকোয় সিঙ্গুলারিটি ইনস্টিটিউট ফর আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স রয়েছে। এতে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছে অনলাইন ব্যাংক পেপ্যালের সাবেক প্রধান নির্বাহী পিটার থিয়েল এবং ফেসবুকের একজন প্রথমদিককার বিনিয়োগকারী। এই ইনস্টিটিউটের আয়োজনে প্রতি বছর সিঙ্গুলারিটি সামিট হয়।

২০১০-এর আগস্টে অনুষ্ঠিত সিঙ্গুলারিটি সামিটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরই যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে তা হলো, জীবনের সীমা বাড়িয়ে দেওয়া বা আয়ুবৃদ্ধি। বেশিরভাগ লোক মানুষের সীমিত আয়ুকে স্থায়ী ও অপরিহার্য ব্যাপার হিসেবে নিলেও, একজন সিঙ্গুলারিয়ান (সিঙ্গুলারিটি তত্ত্বে বিশ্বাসী ব্যক্তি) এটাকে সমস্যা হিসেবে দেখেন, যা নিরাময়যোগ্য। তেমনি মৃত্যুও একটি সমস্যা। বেশি বয়স বা বৃদ্ধাবস্থা অন্যান্য সমস্যার মতোই এক ধরনের অসুস্থতা, যার চিকিৎসা সম্ভব। সিঙ্গুলারিয়ানদের অন্যান্য চিন্তার মতোই এটাও প্রথমে কৌতুকের মতো শোনাবে। তবে যতো বেশি গভীরভাবে দেখা যাবে ততোই এটা আপনার কাছে গুরুত্ব পাবে। এটা যেমন-খুশি-তেমন-চিন্তা না, সত্যি সত্যিই এখানে বিজ্ঞানের হাত রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, শারীরিক অবক্ষয়ের সঙ্গে জড়িত ডিএনএ-র ফিতাকৃতি টেলোমেয়ারের কথা বলা যায়। ক্রোমোসোমের একেবারে প্রান্তে অবস্থান নেওয়া টেলোমেয়ার কোষ বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে ছোট হতে থাকে। একসময় কোষে টেলোমেয়ার নিঃশেষ হলে এর পুনরুৎপাদন হয় না। তখনই কোষ মারা যায়। তবে টেলোমেরাসি নামের একটি এনজাইম আছে যা এ প্রক্রিয়াকে ঘুরিয়ে দেয়। এই কারণেই ক্যান্সারের কোষ বেশি দিন বেঁচে থাকে। তাহলে নিয়মিত অ-ক্যান্সার কোষের চিকিৎসায় টেলোমেরাসির সহায়তা নিলেই তো হয়! গত নভেম্বরে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল নেচার জার্নালে ঘোষণা করে, তারা এটাই করে দেখিয়েছে। একদল বয়স্ক ইঁদুরের শরীরে টেলোমেরাসি প্রয়োগ করে। এরপর তাদের বয়স্কজনিত অসুস্থতা দূর হয়ে যায়। ইঁদুরগুলো কেবল আরও সবলই হয়নি, তরুণ হয়ে গেছে।

রেমন্ডের ভবিষ্যত দুনিয়ায় জৈবপ্রযুক্তি ও ন্যানোপ্রযুক্তি আমাদের শরীর ও চারপাশের দুনিয়ার শক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করবে। প্রগতি ছুটবে হাইপার-ত্বরণে এবং প্রতি ঘণ্টার বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এক শতাব্দীর সমান সময়পরিধীর। ওই সময়ে, আমরাই ডারউইনের পরিখা খনন করব, নিজেরাই নিজেদের বিবর্তনের দায়িত্ব নেব। অসীম জীবন এখন একটি বাস্তবতা। কেউ একজন কেবল তার ইচ্ছানুসারেই মারা যাবে। রেমন্ড আশা করছেন তিনি তার মৃত পিতাকে জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন।

টাইম সাময়িকী অবলম্বনে রানা রায়হান।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।