ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

স্বপ্ন কি ভবিষ্যৎ বলতে পারে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১১
স্বপ্ন কি ভবিষ্যৎ বলতে পারে?

ঢাকা: মানুষ স্বপ্ন কেন দেখে, স্বপ্নে আসলেই কোনো আগাম তথ্য পাওয়া যায় কি না বা স্বপ্ন আসলে কি প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে বহু বছর ধরে গবেষণা চলছে।

হাজার হাজার বছর ধরেই দার্শনিকদের কাছে দারুণ আকর্ষণের বিষয় স্বপ্ন।

তবে কেবল সম্প্রতি স্বপ্ন ব্যবহারিক গবেষণায় স্থান পেয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে বেশ মনোযোগ পাচ্ছে।

স্বপ্ন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। তবে আজো কেউ এর কুল-কিনারা করতে পারেননি।

কেউ বলেছেন স্বপ্নের কোন বাস্তবমূল্য নেই। অপরপক্ষের দাবি মানসিক স্বাস্থ্য, আবেগ-অনুভূতি এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বপ্ন অপরিহার্য।

স্বপ্নের নানা তত্ত্ব
বোস্টনের নিউটন ওয়েলেসলি হাসপাতালে সিøপ ডিজঅর্ডার সেন্টারের পরিচালক আর্নেস্ট হফম্যান বলেন, ‘স্বপ্নের একটি সম্ভাব্য কাজ (যদিও নিশ্চিভাবে তা প্রমাণিত নয়) হলো- স্মৃতির মধ্যে এমন কিছু বিষয়ের সমাগম ঘটানো যা একই সঙ্গে আবেগ-অনুভূতিকে কমিয়ে দেয় এবং ভবিষ্যত পীড়াদায়ক ঘটনা অথবা দুর্ঘটনার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে। ’ আরেক বিশেষজ্ঞ হেনরি ডেভিড থরিউ বলেছেন- ‘স্বপ্ন হলো আমাদের চরিত্রের পরশপাথর’।

বিশ শতকের সবচেয়ে সাড়া জাগানো জার্মান মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড যিনি মনোবিশ্লেষণ নামে মনোবিজ্ঞানের নতুন একটি শাখা উদ্ভাবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন; দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস গ্রন্থে তিনি স্বপ্ন দিয়ে মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন।

তিনি বলেছেন, স্বপ্ন হলো মানুষের অবদমিত ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার ছদ্মবেশী পূর্ণতা লাভ। স্বপ্নে দেখা ঘটনার দুটি অর্থ রয়েছে: বাহ্যিক অর্থ এবং সুপ্ত (নিগুঢ়) অর্থ। প্রথম অর্থে স্বপ্নে চিন্তা-ছবি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের হুবহু চিত্র। আর দ্বিতীয় অর্থটি মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া শেষে আসে।

স্বপ্ন সংক্রান্ত ফ্রয়েডের এ তত্ত্বটি আজো সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃত। তবে গবেষণা কিন্তু থেমে নেই।

এরপর ১৯৭৭ সালে জে অ্যালান হবসন এবং রবার্ট ম্যাককারলি যৌথভাবে স্বপ্নের সক্রিয়করণ ও সংশ্লেষণ মডেল প্রস্তাব করেন। তাদের এ তত্ত্ব মতে, ঘুমের আরইএম (র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট: স্বপ্ন দেখার সময় চোখের পাতা কাঁপে) স্টেজে মস্তিষ্কের সার্কিট সক্রিয় হয়ে ওঠে। এসময় আবেগ, অনুভূতি এবং স্মৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্নায়ুগুলোতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তখন মস্তিষ্ক এই অভ্যন্তরীণ আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করে মর্মোদ্ধারের চেষ্টা করে। উদ্ধারকৃত অর্থই মানুষের মনে-চোখে স্বপ্ন হিসেবে হাজির হয়।

এ তত্ত্ব অনুযায়ী স্বপ্ন কোনো নৈর্ব্যক্তিক বিষয় নয়। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংকেতই আসলে স্বপ্ন। তবে হবসন মনে করেন না যে স্বপ্ন অর্থহীন। তিনি মনে করেন, ‘স্বপ্ন হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে সচেতন এবং সৃষ্টিশীল মুহূর্ত। কখনো কখনো এ বিশৃঙ্খল, বোধগম্য বিভিন্ন ঘটনার সমসাময়িক সমাবেশ এমনকি একটি আস্ত উপন্যাসের প্লট অথবা আনকোরা কোনো চিন্তাও দিতে পারে।

এছাড়াও স্বপ্নের আরও অনেক তত্ত্ব রয়েছে। তবে এ দুটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়।

তবে স্বপ্নের বিষয়টি যতোই জটিল বা ব্যাখ্যাতীত হোক কোনো আসন্ন বিপদের আগ মুহূর্তে কেউ কেউ এর আভাস পেতে পারেন এবং এর পক্ষে জোরালো যুক্তি হাজির করেছেন মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান। তার লেখা ‘প্যারানরমালিটি’ বইয়ে দাবি করেছেন স্বপ্নে মানুষ সত্যি সত্যিই এমন কোনো ইঙ্গিত পেতে পারেন।

ধ্বংসযজ্ঞের ইঙ্গিত
দক্ষিণ ওয়েলসে অ্যাবাফেন গ্রামে ১৯৬৬ সালে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ার আগে এক শিশু স্বপ্নে এমন ইঙ্গিত পেয়েছিল বলে ওই গ্রামে সফরে গিয়ে আরেক মনোবিজ্ঞানী তা আবিষ্কার করেছেন।

১৯৬০ এর দশকে অ্যাবাফেন গ্রাম সংলগ্ন একটি খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে এর অবশেষ মাটির নিচে রাখা হতো। দিনে দিনে অনেক বেশি জমে গেলে তা গ্রামের চারদিক ঘিরে থাকা পাহাড়ে স্তুপ করে রাখা হচ্ছিল। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে ওই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। এতে পাহাড়ের ছিদ্রযুক্ত বালিপাথর চুঁয়ে চুঁয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে ঢুকতে থাকে। এ পানি পাহাড়ের অভ্যন্তরস্থ সুপ্ত ঝর্ণাগুলোর সঙ্গে মিশে বড় ধরনের প্রবাহ তৈরি করে যা সবার অজান্তে ধীরে ধীরে মজুদ কয়লাগুলোকে কাদামাটিতে পরিণত করে।

২১ অক্টোবর সেই বৃষ্টির দিন সকাল ঠিক নয়টায় পাহাড় ধসে কাদামাটির স্রোত দুর্নিবার বেগে গ্রামের ওপর আছড়ে পড়ে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রামের একটি স্কুল। স্কুলে পড়তে যাওয়া ১৩৯টি শিশু এবং পাঁচজন শিক্ষক সেদিন কাদাপানির নিচে পড়ে মারা যান।

এ মর্মান্তিক ঘটনার পরদিন মনোচিকিৎসক জন বারকার ওই গ্রাম পরিদর্শনে যান। প্যারানরমাল বিষয়গুলো নিয়ে বারকারের আগ্রহ প্রবল। এমন একটি দুর্যোগের আগে কেউ না কেউ স্বপ্নে বা অবচেতন মনে ইঙ্গিত পেয়ে থাকতে পারেন এমন বিশ্বাস থেকেই তিনি সেখানে যান।

অ্যাবাফেন গ্রামের এ ভয়াবহ দুর্যোগের আগে কেউ কোনো ইঙ্গিত পেয়েছিলেন কি না অথবা এমন ঘটনা কারো জানা আছে কি না তা জানতে চেয়ে একটি পত্রিকায় তিনি বিজ্ঞপ্তি দেন।

ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস থেকে এ সংক্রান্ত ৬০টি চিঠি তিনি পান যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দাবি করেন, তারা স্বপ্নে এ রকম ইঙ্গিত পেয়েছিলেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে চমক সৃষ্টিকারী অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন ভূমিধসে মারা যাওয়া ১০ বছর বয়সী একটি শিশুর বাবা-মা। তারা জানান, দুর্ঘটনার দিন সকালে তাদের শিশুটি স্কুলে যেতে চাচ্ছিল না। শিশুটি তাদের কাছে আগের রাতে দেখা স্বপ্নের কথা বলে ভয় পাচ্ছিল। সে বলছিল, স্বপ্নে দেখে তাদের স্কুলটি আর নেই। কালো মতো কিছু তাদের স্কুলটি একেবারে ঢেকে ফেলছে। এর কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই ভূমিধস শুরু হয়ে যায়।

৫৪ বছর বয়সী আরেক নারী বলেন, ওই রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন একদল শিশু আয়তাকার একটি কক্ষে আটকা পড়ে আছে। কক্ষটি কাঠের লাঠি দিয়ে ঘেরা ছিল আর শিশুরা এসব লাঠি বেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করছিল।

জন বারকার এ ব্যাপারেব বলছেন, ‘এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক যে, এমন ভীতি স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও ছিল। সম্ভবত এ উদ্বেগই ওই শিশুটির স্বপ্নে প্রতিবিম্বিত হয়। ’

এছাড়াও সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশ মানুষ তাদের জীবনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগাম ইঙ্গিত পান।

এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। আততায়ীর হাতে খুন হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই তিনি বারবার স্বপ্নে দেখেন কেউ তাকে গোপন স্থান থেকে গুলি করছে।

হঠাৎ বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে কফিনের মধ্যে বড় ভাইয়ের মৃতদেহ দেখেছিলেন বলে জানিয়ে গেছেন মার্ক টোয়েন।

বিখ্যাত উপন্যাস ‘টেল অব টু সিটিজ’-এর স্রষ্টা চার্লস ডিকেন্স এমন স্বপ্নের কথা বলেছেন। লাল কাপড় পরিহিত মিস ন্যাপিয়ার নামের এক নারীকে তিনি স্বপ্নে দেখেন। এর মাত্র কয়েকদিন পরেই লাল চাদর পরিহিতা একটি মেয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। কাকতালীয়ভাবে সে মেয়েটি নিজেকে মিস ন্যাপিয়ার বলে পরিচয় দেয়।

১৯৫০ সালে মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ইউজিন অ্যাসারেনস্কি স্বপ্ন বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেন। তিনি আবিষ্কার করেন: আরইএম পর্বে মানুষ যা দেখে তাই আসলে পরে সে স্বপ্ন বলে বর্ণনা করে।

গত কয়েক দশকের অকান্ত গবেষণায় এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে; বেশিরভাগ মানুষই স্বপ্ন দেখে রঙ্গিন। যদিও এসব স্বপ্নের কিছু কিছু উদ্ভট অথবা সাধারণ কাজকর্ম।

ঘুমন্ত কারও কাছে মৃদু সঙ্গীত বাজালে, মুখম-লে উজ্জ্বল আলো ফেললে অথবা মুখে পানি ছিটালে স্বপ্নের মধ্যে বাইরের এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখানোর সম্ভাবনা প্রবল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৮০ শতাংশ স্বপ্নই সাধারণত নেতিবাচক এবং পীড়াদায়ক। এ কারণে ভাল খবরের চেয়ে দুঃখজনক খবরগুলোই স্বপ্নে দেখা ঘটনা স্মরণে প্ররোচনা দেয় বেশি। জরিপে পাওয়া বেশিরভাগ স্বপ্নই দেখা গেছে মৃত্যু অথবা ভয়াবহ দুর্যোগের ইঙ্গিতবাহী। অ্যাবারফান গ্রামে বারকারও ঠিক এমন অভিজ্ঞতাই লাভ করেছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।