ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার মন্তব্য অনুযায়ী, অবস্থা যেন ‘নো ওয়ার নো পিস’ (যুদ্ধ ছাড়া শান্তি আসবে না)। এই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে তুলেছে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারতকে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের স্মৃতি মনে করার হুঁশিয়ারি, আর ভারতীয় সেনাপ্রধানের ‘চীন-পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে একসঙ্গে রুখে দেওয়ার ক্ষমতা’ বিষয়ক মন্তব্য।
নয়াদিল্লি ও কলকাতাভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, এই উত্তেজনা ছড়িয়েছে ১৪ হাজার ফুট উচ্চতার ডোংলাং বা ডোকলাম মালভূমিকে ঘিরে। ৭৬৪ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ডটি ভুটান, ভারত (সিকিম) ও চীন সীমান্তে অবস্থিত। এটিকে থিম্পু ও নয়াদিল্লি ভুটানের মনে করলেও বেইজিং দাবি করে চীনের।
১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর এই মালভূমিতে মোতায়েন থাকে ভারতের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী আইটিবিপি। টহল দিয়ে থাকে সেনাবাহিনীও, তারা আবার আশপাশে স্থাপিত অস্থায়ী বাংকারে বিশ্রাম নিয়ে থাকে। নয়াদিল্লি খবর পায়, ওই মালভূমি এলাকায় সামরিক অবস্থান সংহত করতে বিতর্কিত অঞ্চলেই রাস্তা তৈরির ছক কষছে চীন। নিরাপত্তা প্রশ্নে থিম্পুর আহ্বানে ভারত সেখানে সেনা মোতায়েন বাড়ায়। ভুটানও আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদপত্র পাঠায় বেইজিংয়ে।
এই প্রেক্ষিতে মাস দুই আগে বেইজিংয়ের তরফ থেকে ডোংলাংয়ের লালটেন এলাকার বাংকারগুলো ভেঙে দিতে বলা হয়। ভারত তাতে পাত্তা না দিয়ে সৈন্য-সামন্ত বাড়ালে চটে যায় চীন। তারাও সৈন্য-সামন্ত বাড়িয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বিবৃতি দেয়, চীনের ভূখণ্ডে অন্য দেশের নাক গলানো বরদাশত করা হবে না। পাল্টা প্রতিবাদ জানায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদরদফতর ফোর্ট উইলিয়ামও।
পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় ৬ জুন এ নিয়ে পতাকা বৈঠক হয়। কিন্তু তার দু’দিন পরই ৮ জুন চীনা সেনাবাহিনী ভারতের দু’টি বাংকার গুঁড়িয়ে দেয়। এতে উত্তেজনা সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। ফোর্ট উইলিয়াম সেখানে গ্যাংটকের ১৭ নম্বর ব্ল্যাক ক্যাট ডিভিশন ও সুকনার কোর কম্যান্ডারের অফিস থেকে বাড়তি সৈন্য পাঠায়। কয়েকদিনের মধ্যে দুই পক্ষ থেকে দুই পাশে চার ব্যাটালিয়ন করে আট ব্যাটালিয়ন সৈন্য মোতায়েন করে। কিছু কিছু সামরিক সূত্র অন্তত ২০ হাজার সৈন্য মোতায়েনের কথাও জানাচ্ছে। জানাচ্ছে ব্যাপক অস্ত্র-গোলাবারুদ জমানোর কথাও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারত ফের পতাকা বৈঠকের অনুরোধ জানালেও জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় চীন। শেষ পর্যন্ত ২০ জুন ভারতের এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গেলে চীন এক মেজর জেনারেল নিয়ে পতাকা বৈঠক করে।
কিন্তু বৈঠকেও কোনো ফল আসেনি। চীন সাফ জানিয়ে দেয়, তারা কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে পিছিয়ে যাবে না। ভারতীয় সেনাবাহিনীও ‘চিকেন নেক’র বিষয়টি মাথায় রেখে কোনো ছাড় না দেওয়ার অবস্থান জানায়। ফোর্ট উইলয়াম মনে করে, পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল সীমান্তসহ এই এলাকায় অবস্থা নিজেদের অনুকূল করতে চিকেন নেকে (বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত থেকে নেপাল-ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত এলাকা, যেটাকে শিলিগুড়ি করিডরও বলা হয়। এই এলাকা দিয়েই ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে যোগাযোগ করে) অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে।
অবস্থার বর্ণনায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘আনন্দবাজার’ বৃহস্পতিবার তাদের একটি সংবাদের শিরোনাম করেছে ‘ঢিল পড়তেই গর্জন শুরু ড্রাগনের’। শুক্রবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার বাংলা সংস্করণ ‘এই সময়’র অনলাইনের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে, ’৬৭-র খোঁচা দিয়ে ভারতকে হুমকি চীনের, ‘বেশি বাড় বেড়ো না’। কলকাতাভিত্তিক টেলিগ্রাফইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘সিকিম সেক্টর নিয়ে কথার যুদ্ধে চীন-ভারত’। তারা আরেকটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষিতে কৈলাস মানস সরোবরগামী তীর্থযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে চীন। আপাতত সিকিমে পর্যটক ঢুকতে দিচ্ছে না ভারতও।
শুক্রবার জি নিউজের বাংলা সংস্করণ ২৪ ঘণ্টা জানিয়েছে, বেইজিং নাকি পরিস্থিতি শান্ত করতে ভারতকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছে। এখন এই ডাকে ভারত সাড়া দেবে, নাকি সেই সেনা কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, শান্তির জন্য যুদ্ধকে বিবেচনায় নেবে— সেই ভাবনা ঘাম আনছে সমর বিশেষজ্ঞদের কপালে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৬ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৭
এইচএ/