অবশ্য কাতার দাবি না মানলে সৌদি জোট কি ব্যবস্থা নেবে, তা পরিষ্কার নয়। সামরিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা সংবাদপত্রে আলোচিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি জোটের পক্ষে এ ব্যাপারে খোলাখুলি কিছু বলা হয়নি।
ধারণা করা হচ্ছে আল্টিমেটাম শেষ হলে প্রাথমিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর জোট গালফ কো অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি থেকে কাতারকে বহিষ্কার করা হতে পারে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব অামিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও কুয়েত শক্তিশালী এই আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য। মাত্র ছয়টি দেশের জোট হলেও আঞ্চলিক ভূ রাজনীতি ও বিশ্বের তেলের বাজারের প্রেক্ষিতে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের অবস্থানে সমর্থন আছে জিসিসির দুই রাষ্ট্র বাহরাইন ও আরব আমিরাতের। আবার কাতারের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান না নিলেও নিরপেক্ষ বা কিছুটা কাতারঘেষা অবস্থানে আছে ওমান ও কুয়েত।
তাই জিসিসি থেকে কাতারকে বহিষ্কারের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সিদ্ধান্ত সৌদি আরব বা তার মিত্ররা কতখানি নিতে পারে সেটা পরিষ্কার নয়।
বিষয়টি নিয়ে যে সৌদি জোটের কর্তারা ভাবছেন সে ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে রাশিয়ায় নিযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত গত সপ্তাহে দি টাইমসকে জানান, শর্ত না মানলে আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার সাথে সাথে কাতারকে জিসিসি থেকে বহিষ্কার করা হবে।
এছাড়া কাতারের উপর কঠোর ও সর্বাত্মক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অবরোধ আরোপের ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে কাতারকে একঘরে করতে নিজেদের ব্যবসায়িক অংশীদারদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে সৌদি জোট। মূলত এই বিষয়টিই চাপে ফেলে দিতে পারে কাতারকে।
কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সৌদি জোট বিশেষ করে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপর নির্ভরশীল মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যদি সৌদি জোট এমন দাবি জানায় যে তাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে হলে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে সেক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই কাতারের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হবে বিভিন্ন দেশ। কারণ কাতারের বদলে সৌদি জোটের সঙ্গে থাকাই হবে তাদের জন্য লাভজনক।
পত্র পত্রিকায় উঠে আসছে সামরিক অভিযানের সম্ভাবনাও। ধারণা করা হচ্ছে ইয়েমেনের মত সাবেক মিত্র কাতারেও অভিযান চালাতে পারে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। অবশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষে সে সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে। এছাড়া ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সে সম্ভাবনা কিছুটা কঠিন। কারণ কাতারে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন সেনা ঘাঁটি। ইরাক ও সিরিয়ায় অভিযানের পাশাপাশি ইরানের উপর নজরদারির জন্য কাতারের এই ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
পাশাপাশি ইতোমধ্যেই কাতারে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে মধ্যপ্রাচ্যের অপর শক্তিশালী রাষ্ট্র তুরস্ক। কাতারে সামরিক অভিযান চালানো হলেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে তুরস্ক। কাতারকে হজম করা সৌদি জোটের জন্য যতটা সহজ, তুরস্ককে করা ততটাই কঠিন। এছাড়া এর বিপজ্জনক দিকটি হলো এ ধরনের পদক্ষেপ আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্ক ও ইরানকে এক ছাতার নিচে আনতে পারে।
সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক সঙ্কট থেকে বিশ্ব সঙ্কটে রূপ নিতে পারে কাতার সঙ্কট, যা সামাল দেয়া তখন সৌদি জোটের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বিষয়টি সম্ভবত উপলব্ধি করেছে সৌদি জোটের কর্তাব্যক্তিরাও। এ কারণেই আল্টিমেটামের সময়সীমা পার হলে কাতারের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো কিছু বলা হয়নি তাদের পক্ষে।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার মোহাম্মেদ গারগাশ সিএনএন এর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পাদক নিক রবার্টসনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, কাতারের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপই নেয়া হোক না কেন তাতে কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হবে না। এ ব্যাপারে আবিধাবি সফররত মার্কিন আর্মড সার্ভিস সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান জন ম্যাককেইনকে আশ্বস্ত করেছেন তারা।
জন ম্যাককেইন এবং আরও চারজন মার্কিন সিনেটর শনিবার আবুধাবিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে আলাপকালে নিজেদের উদ্বেগ তুলে ধরলে তাদের আশ্বস্ত করা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষে।
এছাড়া আল্টিমেটাম পার হলেই কাতারের উপর হামলে পড়বে না সৌদি জোট এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন আরব আমিরাতের এই মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ডেডলাইন অতিক্রান্ত হলে কোনো বিগব্যাং এর মত ঘটনা ঘটবে না তার বদলে ধীরে ধীরে কাতারের চারপাশে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ফাঁসগুলো এটে আনা হবে।
অবশ্য ইতোমধ্যেই কাতারের সঙ্গে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সৌদি জোটের দেশগুলো। সেক্ষেত্রে কাতারের উপর নতুন কি অবরোধ আরোপ করা হবে সে ব্যাপারে কিছু জানাননি আনোয়ার মোহাম্মদ গারগেশ।
শেষ পরিস্থিতি এই যে, কুয়েতের মধ্যস্থতায় আল্টিমেটামের মেয়াদ আরও দুদিন বাড়ানো হলেও কাতার জানিয়েছে, কোনো অবস্থাতেই তারা এই ১৩ দফা শর্ত মানতে প্রস্তুত নয়। কারণ তাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। অপর দিকে আল্টিমেটাম শেষ হলে কাতারের বিরুদ্ধে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সে ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য রাখা হয়নি সৌদি জোটের পক্ষে।
সব মিলিয়ে সৌদি জোটের আল্টিমেটাম ও কাতারের অনমনীয় মনোভাবের ফলাফল কি বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয় কারও কাছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৭
আরআই