ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

৮ বছরের শিশুকে গণধর্ষণের পর হত্যা, ভারতজুড়ে তোলপাড়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
৮ বছরের শিশুকে গণধর্ষণের পর হত্যা, ভারতজুড়ে তোলপাড় আসিফার স্কেচ

ফের গণধর্ষণ এবং তারপর হত্যা। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে ভারতজুড়ে। এবার আসিফা বোনো নামে ৮ বছর বয়সী এক শিশুকে গণধর্ষণ ও হত্যায় এ তোলপাড় চলছে পড়শী দেশটিতে। বিচার দাবিতে রাজনীতিক, সুশীল সমাজের নেতা থেকে শুরু করে কলিউড-টলিউড-বলিউডের তারকারা পর্যন্ত সোচ্চার হয়েছেন। শুরু হয়েছে ‘জাস্টিস ফর আসিফা’ (#JusticeForAasifa) হ্যাশট্যাগ প্রচারণাও।

গত ১০ জানুয়ারি ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কাঠুয়া শহরের রাসানা এলাকা থেকে আসিফাকে অপহরণের পর সপ্তাহখানেক আটকে রেখে ধর্ষণ এবং শেষে হত্যা করা হয়। ১৭ জানুয়ারি রাসানার একটি জঙ্গলে তার মরদেহ পাওয়া যায়।

বিষয়টি আলোচনায় এসেছে সম্প্রতি ওই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর।

এ ঘটনায় একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, চার পুলিশ কর্মকর্তা ও এক কিশোরসহ মোট আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা সনজি রাম, পুলিশের বিশেষ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া, সুরেন্দ্র বর্মা, আনন্দ দত্ত ও তিলক রাজ, সনজি রামের ভাগনে (ছদ্মনাম রামু, অভিযোগপত্রে বয়স ১৯ বছর বলা হলেও সংবাদমাধ্যম ১৫ বছর দাবি করে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না), তার বন্ধু পারবেশ কুমার (মানু) ও রামের ছেলে বিশাল জঙ্গোত্রা।

পুরো লোমহর্ষক ঘটনার বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, আসিফা বোনো সংখ্যালঘু বাকারওয়াল জাতিগোষ্ঠীর ইউসুফ বাকারওয়ালের মেয়ে। গোষ্ঠীটি কাশ্মীরের পাহাড়ি এলাকায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়। ভেড়া চড়ানো এদের জীবিকা-নির্বাহের উপায়। এই গোষ্ঠীর কিছু লোক রাসানা এলাকায় বসবাস করতে এলে এখানকার প্রভাবশালী সনজি রাম তাদের তাড়াতে উঠে-পড়ে লাগেন। বাকারওয়ালদের বিরুদ্ধে মাদকপাচার, গো-হত্যাসহ বিভিন্ন উসকানি ছড়ালেও পেরে উঠছিলেন না উগ্র মানসিকতার সনজি রাম। শেষমেষ তিনি তার ভাগনের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পথ বেছে নেন।

অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, বাকারওয়াল গোষ্ঠীকে তাড়াতে সনজি রাম তার ভাগনে রামুকে বলেন ইউসুফের মেয়ে আসিফাকে অপহরণ করতে। তার নির্দেশ মতে রামু এই পরিকল্পনা জানায় তার বন্ধু মানুকে। ৯ জানুয়ারি দুই বন্ধু স্থানীয় একটি দোকান থেকে চেতনানাশক ওষুধ কেনে। ১০ জানুয়ারি আসিফা তাদের ভেড়া চরাতে বের হলে তাকে অপহরণ করে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায় রামু ও মানু। এরপর তাকে ধর্ষণ করে রামু, মানুও ধর্ষণের চেষ্টা করে। পরে দু’জনে আসিফাকে সনজি রামের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি উপাসনালয়ে তালাবদ্ধ করে রেখে দেয়। ১১ জানুয়ারি আসিফার মা-বাবা মেয়েকে খুঁজতে সনজি রামের কাছে গেলে তিনি তাদের আত্মীয়ের বাড়িতে খোঁজ নিতে বলেন। একই দিন রামু খবর দেয় সনজি রামের ছেলে বিশালকে এবং শিশুটিকে ধর্ষণ করবে কি-না জিজ্ঞেস করে। ১২ জানুয়ারি বিশাল সেখানে গিয়ে রামু-মানুদের সঙ্গে যোগ দেয়।  

এদিকে, পুলিশকে জানিয়ে আসিফার খোঁজ চালাতে থাকে বাকারওয়ালরা। এই প্রেক্ষাপটে সনজি রাম বিষয়টি ধামাচাপা দিতে এক পুলিশ সদস্যকে হাত করে ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনন্দ দত্তকে দেড় লাখ রুপি ঘুষ দিতে রাজি করায়। ১৩ জানুয়ারি সকালে বিশাল ও তার বাবা সেই উপাসনালয়ে যায়, সেখানে যায় রামু এবং মানুও। রামু ও বিশাল মিলে ফের ধর্ষণ করে আসিফাকে। সন্ধ্যায় সনজি রাম তার ছেলে-ভাগনেদের বলেন আসিফাকে মেরে ফেলতে। সে কথা মতো, রামু, মানু ও বিশাল তাকে নিয়ে যায় একটি কালভার্টে। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সনজির হাত করে নেওয়া সেই পুলিশ কর্মকর্তা দীপক। আবার ছোট্ট দেহের মেয়েটিকে ধর্ষণ করে রামু এবং দীপক। এরপর দীপক তার চাদর আসিফার গলায় পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। রামু মেয়েটির মাথা পাথর দিয়ে থেতলে দেয়। সেখানেই ফেলে রাখা হয় তার মরদেহ। ১৫ জানুয়ারি মেয়েটির মরদেহ নিয়ে ফেলে দেওয়া হয় অদূরের জঙ্গলে। ১৭ জানুয়ারি সেখান থেকে মরদেহটি উদ্ধার করেন স্থানীয়রা, খবর পেয়ে পুলিশ এসে মরদেহটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ৬০ বছর বয়সী সনজি রামই পুরো ঘটনাটির মূল পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী। যে উপাসনালয়ে মেয়েটিকে অপহরণ করে বন্দি রাখা হয় এবং ধর্ষণ করা হয়, সেটি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন এই সনজি রামই। আর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল রামু, মানু, বিশাল এবং পুলিশ কর্মকর্তা দীপক। এমনকি পুলিশ কর্মকর্তা দীপক মেরে ফেলার আগে আরও একবার ধর্ষণ করতে চান আসিফাকে।

ঘটনার বর্বরতা স্তম্ভিত করেছে বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে বলিউডসহ সব চলচ্চিত্রপাড়ার কলা-কুশলীদের। বৃহস্পতিবার রাতেই আসিফা ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে ইন্ডিয়া গেটে মোমবাতির মিছিল করেন রাহুল। সেখানে যোগ দেন সরকারি চাকরিজীবী থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

এ বিষয়ে টুইটারেও চলছে প্রতিবাদের ঝড়। রাহুল গান্ধী এ নিয়ে টুইট করেন, ‘এমন অপরাধীদের কেউ কিভাবে পারে আড়াল করতে? আসিফার সঙ্গে যেটা হয়েছে, সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধ, এই অপরাধের শাস্তি না হয়ে পারে না। একটি নিষ্পাপ বাচ্চার প্রতি যে অকল্পনীয় নৃশংসতা হলো, সেটাতেও যদি আমরা নিজেদের রাজনীতির প্রভাব খাটাই, তাহলে আর কী বলা যায়?’

টুইটারে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন অভিনেতা-রাজনীতিক-ক্রীড়াবিদরা, যাদের মধ্যে রয়েছেন ড. কামাল হাসান, জাবেদ আখতার, অক্ষয় কুমার, করণ জোহর, সানিয়া মির্জা, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, রীতেশ দেশমুখ, ফারহান আখতার, গৌতম গম্ভীর, আনুশকা শর্মা, তামান্না ভাটিয়া, সোনম কাপুর, পরিণীতি চোপড়া, হুমা কোরেশী, কালকি কোয়েচলিন, নুসরাত জাহান, মিমি, কৃতী শ্যানন, এশা গুপ্তা, বিশাল দাদলানি, মানুষী চিল্লাররা।

তবে এ ঘটনা নিয়ে এতো দিন মুখ না খুললেও বিক্ষোভের আগুন ছড়াতেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ টুইট করেন, ‘আসিফাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলাম। কিন্তু বিচার ওকে পাইয়ে দিতেই হবে। ’

২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির চলন্ত বাসে নির্ভয়া ছদ্মনামে এক তরুণীকে গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পুরো ভারতে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। পরে অবশ্য ওই ঘটনার ৬ অভিযুক্তকে সাজা দেওয়া হয়। এরমধ্যে চারজনেরই হয় মৃত্যুদণ্ড।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।