ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

কোরিয়া উপদ্বীপে ‘শান্তির সুবাতাস’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৮
কোরিয়া উপদ্বীপে ‘শান্তির সুবাতাস’ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ঐক্যের বার্তা দিলেন দুই নেতা কিম জং-উন ও মুন জে-ইন

তিন বছরব্যাপী লাখ লাখ প্রাণক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রায় পাঁচ দশক ধরে কেবল বিচ্ছিন্নতা ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে উত্তেজনার উত্তাপই ছড়াচ্ছিলো কোরীয় উপদ্বীপে। হঠাৎ হঠাৎ উসকানিতে সীমান্তে মরণাস্ত্রের ঝনঝনানি নির্ঘুম রাখছিলো উপদ্বীপ ও তার আশপাশের বাসিন্দাদের। গত বছরের শুরু থেকে এ বছরের শুরু পর্যন্ত উপদ্বীপটি ঘেঁষে সামরিক যুদ্ধযানের মহড়া যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলো, তাতে পরমাণু বোমা নিক্ষিপ্ত হলে কতো প্রাণহানি হতে পারে, সেই ‘হিসাব’ও কষা হচ্ছিলো। তবে সেই ‘দুঃসময় শেষ হতে চলেছে’। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার দুই প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন ও মুন জে-ইন দু’দেশের সীমান্তগ্রাম ‘পানমুনজমে’ এক ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। সেই বৈঠকের পর দু’জনের স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ঘোষণায় এখন ‘শান্তির সুবাতাস’ বইছে কোরিয়া অঞ্চলে। 

শুক্রবার (২৭ এপ্রিল) ‘সুপ্রভাতেই’ এ শান্তির বার্তা নিয়ে সীমান্তগ্রাম ‘পানমুনজমে’ পা রাখেন কিম ও মুন। ‘প্রতিপক্ষ’র অবস্থান থেকে আসন ছেড়ে প্রথমে উত্তরের ‘যুদ্ধংদেহী’ প্রেসিডেন্ট কিমই স্বদেশের সীমারেখা পেরিয়ে ‘পানমুনজমে’ এগিয়ে যান।

সেখানে তাকে স্বাগত জানান দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট মুন। তখন অভাবনীয়ভাবে কিম আমন্ত্রণ জানান মুনকে, জবাবে দক্ষিণের নেতা সীমারেখা টপকে উত্তরের মাটিতে পা রাখেন। উচ্ছ্বসিত দুই প্রেসিডেন্ট এগিয়ে যান পরস্পরের দিকে, করেন করমর্দন। এরপর হাত ধরেই কিমকে সীমারেখা পার করে দক্ষিণে নিয়ে যান মুন। কোরিয়া যুদ্ধের পর উত্তরের প্রথম কোনো নেতা হিসেবে দক্ষিণে পদার্পণ করা কিমকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। তারপর দু’জনে হাত ধরেই একটি বাড়িতে বৈঠক করতে যান। ঐতিহাসিক মুহূর্তে ঐক্যের বার্তা দিলেন দুই নেতা কিম জং-উন ও মুন জে-ইনদুই নেতা কর্মকর্তাদের নিয়ে যে বাড়িটিতে এই ঐতিহাসিক বৈঠক করেন, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পিস হাউস’ বা শান্তির বাড়ি। এই শান্তির বাড়িতে বৈঠকের পর কিম ও মুন অসামরিকীকৃত অঞ্চলে (ডিমিলিটারাইজড জোন-ডিএমজেড) গাছের চারা রোপণ করেন। চারা রোপণকালে কিম ব্যবহার করেন দক্ষিণের মাটি, আর মুন ব্যবহার করেন উত্তরের মাটি। এরপর দুই নেতা ডিএমজেড দিয়ে হেঁটে একটি ফুটওভার ব্রিজে পাতা আসনে বৈঠক করেন। পুরো ব্রিজটি সাজানো হয় ঐক্যের প্রতীক নীল রঙে। এখানে প্রায় ৩০ মিনিট দু’জনে একান্তে আলাপ করেন।

এই বৈঠকের পর কিম ও মুনের স্বাক্ষরিত একটি ‘যৌথ ঘোষণা’ দেওয়া হয়। এই ঘোষণায়ই কোরীয় উপদ্বীপের বাসিন্দাদের দেওয়া হয় দশকের পর দশক ধরে কাঙ্ক্ষিত অনেক সুখবর। যার মধ্যে ছিল কোরিয়া অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে মতৈক্য এবং কোরীয় যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানে ও সংঘাত বন্ধে আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রক্রিয়ার কথা। ঘোষণার প্রধান বিষয়গুলো হলো---
>> ১. পরমাণুমুক্ত কোরীয় উপদ্বীপ গড়ে তোলার অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে সম্মত দুই দেশ।
>> ২. প্রায় ৬৫ বছর আগে শেষ হওয়া কোরীয় যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানে এবং সংঘাত বন্ধে শান্তি চুক্তি করবে দু’পক্ষ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বিশ্ব ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সহযোগিতা থাকবে।
>> ৩. উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী যৌথ শিল্পাঞ্চল ‘কায়েসংয়ে’ দু’পক্ষের ‘লিয়াজোঁ’ অফিস গঠিত হবে। এই শিল্পাঞ্চলে কার্যক্রম রয়েছে দুই কোরিয়ারই। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আগে এই শিল্পাঞ্চল বন্ধ করে দেওয়া হতো।
>> ৪. জাতীয় পুনর্মিলন ও ঐক্যের স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিবেচনার জন্য দু’পক্ষ সর্বস্তরে সহযোগিতা, বিনিময়, সফর ও যোগাযোগকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে।
>> ৫. দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন চলতি বছরের শেষ দিকেই পিয়ংইয়ং সফর করবেন। তার আগে মে অথবা জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন।
>> ৬. দু’পক্ষ আগামী ১৫ জুন একটি বিশেষ সভায় বসবে।
>> ৭. উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ান গেমসের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরে যৌথভাবে অংশ নেবে। এবার ১৮ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় বসবে এশিয়ান গেমসের আসর।
>> ৮. কোরীয় উপদ্বীপের বিভাজনে আলাদা হয়ে যাওয়া দুই দেশের নাগরিকদের পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে পুনর্মিলনে প্রতিবছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় অনুষ্ঠান হবে সীমান্তে।
>> ৯. সীমান্তে হামলা বা সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ এবং উসকানিমূলক যে কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করবে দু’পক্ষ।
>> ১০. দু’দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হবে।

এই ঘোষণার পর উচ্ছ্বসিত বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচিত হলো। আমরা সবাই এই মুহূর্তের জন্য দীর্ঘ-প্রতীক্ষায় ছিলাম। আশা করি দুই কোরিয়া আবার ‘পুনর্মিলিত’ হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঐতিহাসিক আলোচনা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন আর দীর্ঘায়িত হতে পারে না। ’

শান্তির ডাক দিয়ে কিম বলেন, ‘আমরা এমন কোনো মানুষ নয়, যারা সবসময় সংঘাতই চায়...আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়েই বাঁচতে হবে। শান্তি বজায় রাখতে হবে এবং কোরিয়ান উপদ্বীপের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যৌথ-সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনা করতে হবে। ’

আর ২০১৭ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর শান্তির স্বার্থে নমনীয় স্বরে কথা বলে আসা দক্ষিণের মুন বলেন, ‘কোরীয় উপদ্বীপে আর কখনও যুদ্ধ হবে না। এখান থেকেই শান্তির নবযুগের সূচনা হলো। ’অসামরিকীকৃত অঞ্চলে গাছের চারা রোপণের পর উচ্ছ্বসিত কিম ও মুনগত শতাব্দীতে হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই আলাদা হয়ে যায় দুই কোরিয়া। এরপর দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালের জুন থেকে ১৯৫৩ সালের জুলাই পর্যন্ত দুই কোরিয়ার মধ্যে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয়। তিন বছরেরও বেশি সময়ের ওই যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে ছিল চীন ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), আর দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে ছিল জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পশ্চিমা জোট। যুদ্ধে আনুমানিক সাড়ে সাত লাখ উত্তর কোরীয় ও পৌনে দুই লাখ দক্ষিণ কোরীয় নিহত হয়।

ওই যুদ্ধের পর থেকে কয়েক দফায় সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয় দুই কোরিয়ার মধ্যে। সবশেষ গত বছরের শুরু থেকে এ বছরের শুরু পর্যন্ত উপদ্বীপটি ঘেঁষে সামরিক যুদ্ধযানের মহড়াও আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলো। উত্তরের দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও ‘পরমাণু বোমা’র পরীক্ষার প্রস্তুতির খবরে মিত্র দক্ষিণকে ‘রক্ষায়’ প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধবিমানবাহী একাধিক রণতরী পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রও। উত্তর কোরিয়াকে ‘শায়েস্তা’ করতে ওয়াশিংটন হুমকি দিলে পিয়ংইয়ং উল্টো তাদেরই ‘পস্তানো’র হুঁশিয়ারি দেয়।

তবে ‘শান্তিকামী’ মুনের প্রচেষ্টায় এবং চীনের মধ্যস্থতায় উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা কমে আসে। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনায় বসতে সম্মত হন। আগ্রহ দেখান শান্তি প্রক্রিয়ায়। সেই আগ্রহের ফল দেখা যায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কিম ও মুনের বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণা যেন শান্তি প্রক্রিয়ার ‘অগ্রবার্তা’ হিসেবে প্রকাশ পায় বিশ্ববাসীর সামনে।

এই অগ্রবার্তাকে স্বাগত জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপানসহ গোটা বিশ্ব। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হয়, ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়ায় বেইজিং সাধুবাদ জানাচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদ্বয়কে। একইসঙ্গে তাদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সাহসের প্রশংসা করছে। চীনের প্রবাদ অনুযায়ী বলতে হয়, ভাইয়ের বন্ধন ছিন্ন করার মতো শক্তি কোনো বিপর্যয়েরই নেই। আমরা আশা করি এই ঐতিহাসিক বৈঠকের মাধ্যমে কোরীয় উপদ্বীপে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার যে নতুন পথ তৈরি হলো, তা লুফে নেবে দুই পক্ষ। ’

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে দুই দেশকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়, রেলওয়ে পরিবহন, গ্যাস ও বৈদ্যুতিক জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়াকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত মস্কো।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে দু’পক্ষকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘শেষ হচ্ছে কোরিয়ার যুদ্ধ! কোরিয়ায় এখন যা ঘটছে, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মহান জনগণের গর্বিত হওয়া উচিত। ’ তিনি কোরীয় উপদ্বীপের এই শান্তি প্রক্রিয়া আনার ক্ষেত্রে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকেও কৃতিত্ব দেন।

পর্যবেক্ষকরা ‘যৌথ ঘোষণা’র ‘বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া’র দিকে নজর রাখলেও আপাতত কোনো পক্ষকেই কৃতিত্ব দিতে কার্পণ্য করছেন না। যেমন সিউলভিত্তিক কোরীয় উপদ্বীপের ভবিষ্যৎ ফোরামের (কেপিএফএফ) সিনিয়র ফেলো দুয়েন কিম বলেন, ‘পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণ’ শব্দসহ যৌথ ঘোষণা মুনেরই জয়, এজন্য যে তাদের সভা ট্রাম্প-কিম আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এদিক থেকে কিম যদি ‘সিরিয়াস’ নাও হন, পরমাণুর ব্যাপারে মূল খেলাটা হবে তার (মুন) ও ট্রাম্পের মধ্যে।

খেলা যাদের মধ্যেই হোক, শেষ পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপ পরমাণুমুক্ত হলেই হয়, তা হলে যে কোরিয়ার বাসিন্দারাই ‘দুশ্চিন্তাহীন এক লম্বা ঘুম’ দিতে পারবেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৮
এইচএ/

আরও পড়ুন
** কিম-মুনের বৈঠকের বিশেষ ১৩ পয়েন্ট
** পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে একমত দুই কোরিয়া
** কোরিয়া যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানে এ বছরই চুক্তি
** দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলেন উত্তরের নেতা কিম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।