প্রায় দুই বছর ধরে একটু একটু করে নিজেকে বদালাতে থাকে গ্রেটা থানবার্গ। পরিবারকে বোঝায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য।
এভাবে নিজের পরিবার দিয়েই পরিবর্তনটা শুরু করে গ্রেটা। এতটুকু একটা মেয়ের মধ্যে আগামীর বিশ্ব নিয়ে যে চিন্তা, সেটা দেখে বিস্মিত হতে থাকেন অনেকেই। সেই আট বছর বয়সে যে শুরু, সেটা চলতে থাকলো শৈশব পেরিয়ে কৈশোরেও। আগস্ট, ২০১৮। গ্রেটা দেখলো, এভাবে পরিবর্তন সম্ভব নয়। সিদ্ধান্ত নিল ‘স্কুল স্ট্রাইক’ করার। যেই ভাবা, সেই কাজ। সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসে একাই শুরু করলো জলবায়ু পরিবর্তন সংকট নিরসনে সচেতনতা সৃষ্টির লড়াই।
আরও পড়ুন> বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ‘স্বল্পজ্ঞানী’ গ্রেটার নীরব লড়াই
গ্রেটার বাবা মেয়ের এই স্কুল বন্ধ করা একদম পছন্দ করেননি। কিন্তু, তিনি বুঝতে পারেন যে, গ্রেটা নিজের জায়গা থেকে কিছু করতে চাইছে। বিষণ্ন হয়ে বাসায় বসে থাকার চেয়ে আন্দোলন করে সে যদি সুখে থাকে, তবে তাই হোক।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের এক স্কুলে গুলিতে সেখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলে যাওয়া নিয়ে ভীতি তৈরি হলে অনেকেই সাময়িকভাবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া গ্রেটার মাথায় তখনই আসে স্কুলে না গিয়ে আন্দোলন করার বুদ্ধি। এই আন্দোলন এখন ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’ নামে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
২০১৮ সালের মে মাসে এক সুইডিশ পত্রিকা আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তন রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় গ্রেটা থানবার্গ। তার লেখাটি প্রকাশিত হলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী একটি সংস্থা থেকে গ্রেটার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু, প্রত্যক্ষভাবে কিছু করতেই বেশি আগ্রহী মেয়েটি। তাই সে স্কুল স্ট্রাইক চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সুইডেনে ২৬২ বছরের ইতিহাসে সর্বাধিক তাপমাত্রার গ্রীষ্মকাল গেছে গতবছর। সুইডিশ সরকার যেন কার্বন নিঃসরণ কমাতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়, সে দাবিতে টানা স্ট্রাইক করে যায় গ্রেটা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে তার একাকী আন্দোলনের ছবি ছড়িয়ে পড়লে সাড়া জাগে গোটা বিশ্বে।
সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে একা শুরু করা এই আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের লক্ষাধিক স্কুলশিশুর মধ্যে। এই আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’। গত জানুয়ারিতে গ্রেটাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ডেভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামে। সেখানে তার বক্তব্য নাড়িয়ে দেয় বিশ্ববিবেক।
মাত্র ১৩ মাসেই জলবায়ু আন্দোলনের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে ১৬ বছরের এই কিশোরী। সব সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে তার আন্দোলন। শুধু মুখের কথায় নয়, গ্রেটা রাস্তায় নেমে আন্দোলনে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে লাখো মানুষকে।
২৩ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জলবায়ু বিষয়ক বৈঠকে গ্রেটা থানবার্গের বক্তব্য পুরো বিশ্বে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছৈ। ‘হাউ ডেয়ার ইউ’ হ্যাশট্যাগে মুখরিত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি, সমাজকর্মী ও বিজ্ঞানীরা শেয়ার করেছেন গ্রেটার এই বক্তব্য। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের আন্দোলন, তাতে যোগ দিয়েছে সব বয়সী মানুষ।
আরও পড়ুন> জলবায়ু আন্দোলনে গ্রেটার পাশে গোটা বিশ্ব
সেদিন বিশ্বনেতাদের সামনে বসে গ্রেটা বলে, আমার তো এখানে থাকার কথা নয়, কথা ছিল স্কুলে থাকার। অসংখ্য মানুষ কষ্ট করছে, মারা যাচ্ছে। সারা বাস্তুসংস্থান ভাঙনের মুখে। আমরা বিলুপ্তির পথে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ, আপনারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রূপকথার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা সব জেনে-বুঝেও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তাদের উদ্দেশে গ্রেটার সতর্কবাণী, আমরা আপনাদের বেইমানি বুঝে ফেলেছি। এখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চোখ আপনাদের ওপর। আমাদের রক্ষায় যদি ব্যর্থ হন, মনে রাখবেন, আমরা আপনাদের কোনোদিন ক্ষমা করবো না।
গ্রেটার আগুনঝরা এ বক্তব্যে সেদিন চুপ হয়ে গিয়েছিলেন বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা। সমালোচনা তো নয়ই, বরং তার কথা স্বীকার করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমান্যুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, আমরা এখন শুধু মুখে জলবায়ুর কথা বলে পার পাবো না যে, সবকিছু ঠিক আছে বা আমরা যা করছি সব ঠিক করছি।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও মেনে নেন, এই প্রজন্ম বিশ্বকে রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু, এই দৌড়ে জয়লাভ করাটা খুব একটা অসম্ভব নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখায় এবারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে এ সুইডিশ কিশোরী। এরই মধ্যে, এবছর বিকল্প নোবেলখ্যাত ‘রাইট লাইভলিহুড’ পুরস্কার পেয়েছে গ্রেটা থানবার্গ। এছাড়া, গত এপ্রিলেই বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের নজরে প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে এ কিশোরী। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে বলা হচ্ছে ‘নেক্সট জেনারেশন লিডার। ’
তবে, সমর্থনের পাশাপাশি সমালোচকেরও অভাব নেই গ্রেটার। জাতিসংঘে তার বক্তব্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় একই কথা বলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। তার মতে, গ্রেটা হচ্ছে খুবই অল্প জানা এক কিশোরী, যাকে প্রাপ্তবয়স্করা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে।
যদিও, সমালোচকদের মন্তব্য নিয়ে মাথাব্যথা নেই গ্রেটার। কিশোর-কিশোরীরা বিজ্ঞানের কথা ছড়িয়ে দিচ্ছে, এতে বড়দের ভয় পাওয়ার কী আছে! তারচেয়ে বরং তাদের উচিত জলবায়ু পরিবর্তন সংকট সমাধানে কাজ শুরু করা। তাই তো সবার জন্য গ্রেটার বার্তা, বিশ্ববাসী সচেতন হচ্ছে, রাস্তায় দেখা হবে আপনাদের সঙ্গে। বর্তমানে গ্রেটার শুরু করা স্কুল স্ট্রাইকের ৫৯ সপ্তাহ চলছে। চলবে আরও...।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১৯
এএ/একে