বিশ্বজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান ও বিভিন্ন বাহিনীর হস্তক্ষেপে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও রাশিয়ার দিমিত্রি মুরাতভ হলেন তেমনই দুই সৈনিক। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রচেষ্টার লড়াইয়ে অংশ নিয়ে তারা জিতেছেন নোবেল পুরস্কার।
বাছাই করা ৩২৯ জনের তালিকা থেকে শুক্রবার (৮ অক্টোবর) তাদের দুজনের নাম ঘোষণা করে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির চেয়ারওম্যান বেরিট রিস-এন্ডারসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাদের দুজনকে নিজ দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সাহসী লড়াইয়ের জন্য পুরস্কৃত করা হয়েছে।
নোবেল কমিটি জানায়, ‘স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করে গণতন্ত্র ও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি নিশ্চিত করায়’ এ পুরস্কারের জন্য ফিলিপাইনের মারিয়া রেসা ও রাশিয়ার দিমিত্রি মুরাতভকে বেছে নেওয়া হয়েছে। বিশ্বে সাংবাদিকরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নৈতিক সাংবাদিকতার চর্চা করছেন, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে রেসা ও মুরাতভের এই স্বীকৃতি।
মারিয়া রেসা
৫৮ বছর বয়সী রেসা ফিলিপাইনের প্রথম নোবেল শান্তি বিজয়ী। তিনি র্যাপলার নামের একটি ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১২ সালে র্যাপলার নামের একটি ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থা চালু করেন মারিয়া রেসা। এর উদ্দেশ্য ছিল ফিলিপাইনের ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা ও রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালানো। গণমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো ও বিরোধী শক্তি দমনের বিরুদ্ধে সক্রিয় মারিয়া রেসার ওই সংগঠনটি।
ফিলিপাইনে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে পুলিশের ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তদন্ত চালায় র্যাপলার।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে রেসা লিখেছিলেন, সরকারের সঙ্গে লড়াই করার জন্য আমি প্রস্তুত হইনি। কিন্তু আমার কাজ করার জন্য এটি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
নিবন্ধ লেখার কারণে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের রোষানলে পড়তে হয় রেসাকে। তাকে গ্রেফতার করা হয়। র্যাপলার ওয়েবসাইটে সরকারের সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দুতার্তের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন রেসা।
এত কিছুর পরও রেসা থেমে থাকেননি। চলতি মাসের আগস্টে ফিলিপাইনের একটি আদালত রেসার নামে করা একটি মানহানির মামলা খারিজ করে দেয়। যদিও দেশটিতে অনেক সাংবাদিকের নামে এখনও মামলা চলছে।
বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রেখে যেভাবে ফিলিপাইনে মারিয়া রেসা ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, ঊর্ধ্বমুখী সহিংসতা এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্বপরায়ণতার খবর প্রকাশ করেছেন’, এর জন্য তিনি প্রশংসিত।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর মারিয়া রেসা বলেন, তার বিজয় প্রমাণ করে যে, তথ্য ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়... তথ্যবিহীন বিশ্বের অর্থ হলো সত্য ও আস্থাহীন পৃথিবী।
দিমিত্রি মুরাতভ
কয়েক দশক ধরে রাশিয়ায় মুক্ত চিন্তা চর্চার জন্য লড়ছেন ৫৯ বছর বয়সী দিমিত্রি মুরাতভ। ১৯৯৩ সালে নোভায়া গ্যাজেটা পত্রিকাটি চালু করেন তিনি। দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে রাশিয়া যেভাবে সামরিক তৎপরতা বজায় রেখেছে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করে সরকারের রোষের শিকার হন তিনি। এছাড়া দুর্নীতি, ভোট চুরি ও আইন বহির্ভূত গ্রেপ্তারের বিষয়েও সোচ্চার ওই পত্রিকাটি।
মুরাতভ রাশিয়ার অনুসন্ধানী সংবাদপত্র নোভায়া গ্যাজেটার প্রধান সম্পাদক। ইউক্রেনের সংঘাতকে ব্যাপকভাবে কাভার করে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনেক অন্যায় ও দুর্নীতি নিয়েও তদন্ত করেছেন এই সাংবাদিক।
ছয় বছর আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্স মুরাতভের সাক্ষাৎকার নেয়। ওই সময় তার কার্যালয়ের হলজুড়ে নোভায়া গ্যাজেটার ছয় নিহত সাংবাদিকের ছবি টাঙানো ছিল। তারা ২০০১ সালের পর নিহত হয়েছেন।
ওই সাংবাদিকদের একজন আনা পলিটকভস্কায়া। তিনি চেচনিয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে নির্ভীক প্রতিবেদনের জন্য বেশ পরিচিত ছিলেন। ২০০৬ পুতিনের জন্মদিনে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
নোবেল শান্তি পুরস্কারে নাম আসার পর জনপ্রিয় টেলিগ্রাম চ্যানেল পডিওমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিমিত্রি মুরাতভ জানান, তিনি আশা করেননি যে, তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে।
এই পুরস্কার পাওয়ার পর দিমিত্রি মুরাতভকে অভিনন্দন জানিয়েছে ক্রেমলিন। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিনি প্রতিভাবান ও সাহসী।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, ডয়েচে ভেলে ও আল-জাজিরা।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০২১