উভয় জাহানের সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ইসলামের কাম্য। পবিত্র কোরআনের আয়াতে উভয় জীবনের কল্যাণের কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু আমাদের সমাজের কিছু অজ্ঞ মানুষ ইসলামের প্রধান এ দাবির প্রতি আদৌ ভ্রুক্ষেপ করে না। সমাজের শান্তি ও সস্তি, মানুষের জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। তারা ইসলামের ছোটখাটো বিষয়কে এতটাই গুরুত্ব দেয় যে, এ ক্ষেত্রে নূন্যতম কোনো সহনশীলতার পরিচয় দিতে অক্ষম।
ইসলামের ছোটখাটো বিষয়ের জন্য তারা এতটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠে যা রীতিমতো পিলে চমকে উঠে। এমনি একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে লক্ষীপুর সদর উপজেলায়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, লক্ষীপুর সদর উপজেলার কালিচর গ্রামের মনছুর আহমাদ জামে মসজিদের ইমাম মুহা. আল আমিন নামাজের পর অন্য ইমামের মতো মোনাজাত করতেন না।
বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার (৯ জুন) জুমার নামাজের পর মসজিদের সেক্রেটারি ইমাম সাহেবের কাছে কৈফিয়ৎ চান। এটা নিয়ে ইমাম ও সেক্রেটারির মাঝে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এর জের ধরে রাতে তারাবির পর ইমাম পক্ষের লোকজন সেক্রেটারির পক্ষের লোকজনের ওপর আক্রমণ করে। এ ঘটনায় কয়েকজন আহতও হয়। হামলায় আহত নুর হোসেন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
বর্ণিত ঘটনায় অসহিষ্ণু ও মূর্খ কিছু মানুষের হাতে ধর্ম, বিবেক, মানবতা সব কিছুরই চরম পরাজয় ঘটেছে। ভাবতেও অবাক লাগে- মোনাজাতের মতো বিষয় নিয়ে একজন মানুষ আরেক জনকে বকা দিতে পারে, আঘাত করতে পারে, জানে মেরে ফেলতে পারে! এও কি সম্ভব!!
ইসলাম ধর্মে নামাজের পর মোনাজাত করা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বিষয়। কোরআন, হাদিস, সাহাবা ও ইমামদের বক্তব্য কোথাও নামাজের পরের মোনাজাতকে আবশ্যিক করা হয়নি। আবার সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে একে নিষেধও করা হয়নি।
তাই নামাজের পরের মোনাজাত নিয়ে কারও সঙ্গে সামান্যতম মনোমালিন্যের সুযোগ ইসলামে নেই। কাউকে দৈহিকভাবে আঘাত করার তো প্রশ্নই উঠে না।
পবিত্র মক্কা ও মদিনার সম্মানিত দুই মসজিদসহ গোটা আরব অঞ্চলে নামাজের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মিলিত মোনাজাত করা হয় না। ভারত উপমহাদেশের প্রায় সকল মসজিদে শত শত বছর ধরে মোনাজাত করা হয়।
আবার বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় এবং আহলে হাদিসদের মসজিদগুলোতে মোনাজাত করা হয় না। কিন্তু এসব মসজিদে একমতের লোকজন অপর মতের স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায় করেন। পরষ্পর হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেন, নিজেদের মাঝে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন।
তাই সহজেই বলা যায়, সাধারণ ভাবে এ দেশের মুসলমানরা নামাজের পরের মোনাজাত নিয়ে পরষ্পর সহনশীল। এটা নিয়ে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধে কোনো ফাটল ধরেনি।
সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, আলোচিত ঘটনাটি ধর্মের কারণে বা ধর্মের জন্য ঘটেনি। বরং ঘটনাটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে ঘটেছে। ধর্ম এখানে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র।
মানুষ খুনের প্রকৃত আসামী কে, তা নির্ণয় করে দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করবেন মহামান্য আদালত। সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আমরা এখানে আলোচনা করছি পরিস্থিতির দায় নিয়ে।
বর্ণিত ঘটনায় মসজিদের ইমাম ও সেক্রেটারি বিবাদের জন্য সমানভাবে দায়ী। নামাজের পর আনুষ্ঠানিক সম্মিলিত মোনাজাত নিয়ে যেহেতু ইসলামের রেফারেন্সে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই এবং এ বিষয়ে অনেক আগে থেকেই পৃথিবীতে দু ধরণের প্রথা প্রচলিত- সেহেতু মসজিদের একজন ইমাম তিনি নিজ পছন্দে ও নিজ জ্ঞানে যে কোনো মতকে গ্রহণ করার অধিকার রাখেন।
কেননা, তিনি ইমাম। তবে আলোচিত ঘটনায় ইমামের ব্যর্থতা ও দায় হলো- তিনি নিজের মতের পক্ষে স্থানীয় জনমত গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন। জনমত গঠন না করে, মানুষকে না বুঝিয়েই তিনি স্থানীয় সমাজের প্রচলিত প্রথার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। মসজিদের মতো স্পর্শকাতর সামাজিক প্লেসে এভাবে দায়িত্ব পালন করা যায় না।
আর মসজিদের সেক্রেটারির ব্যর্থতা ও দায় হলো- তিনি একজন ইমামের কাছে সরাসরি কৈফিয়ৎ তলব করেছেন। এটা জঘন্যতম অভদ্রতা এবং নিন্দনীয় অসৌজন্যতা। মসজিদের সেক্রেটারি পদে দায়িত্ব পালনের জন্য তার আরও কৌশলী, বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া দরকার ছিল।
বিতর্কিত বিষয়ে, বিশেষত যে বিষয়ে সারা বিশ্বে দু’টি আমলের প্রচলন আছে; সে বিষয়ে একজন ইমাম একটি মত গ্রহণের পর সেক্রেটারি তার পদের জোরে ইমামকে ভিন্নমত গ্রহণে বাধ্য করতে পারেন না। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়।
বরং তিনি ইমাম নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে জেনে নিতে পারতেন- বিতর্কিত বিষয়গুলোতে প্রস্তাবিত ইমাম কোন মতের অনুসারী। এটা জেনে-বুঝে ইমাম নিয়োগ দিলে আজ এত বড় ঘটনা ঘটত না।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- যেখানে হাদিসে রমজান মাসে পার্থিব বিষয় নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সেই রমজান মাসে, মসজিদের ভেতরে ইমাম-সেক্রেটারি কীভাবে বাদানুবাদে লিপ্ত হলেন? দু’পক্ষের লোকজনের মাঝে কীভাবে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো? যারা মসজিদের খাদেম, তারা ঝগড়া করে কীভাবে পবিত্র মাসের, পবিত্র দিনের, পবিত্র স্থানের অমর্যাদা করলেন?
দুপুরের মৌখিক ঝগড়ার পর ইমাম পক্ষের লোকজন রাতে বিপক্ষের ওপর হামলা করল- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। পবিত্র রমজানের প্রশান্তিদায়ক ইফতার, তারাবির মতো বরকতময় নামাজ কোনো কিছুই কি তাদের অশান্ত মন শান্ত করতে পারল না?
মানুষ কতটা বদমেজাজি ও অহংকারী হলে এমনটি করতে পারে! ইমাম সাহেব এখানে কী ভূমিকা রেখেছেন? সমাজের শান্তি, সম্প্রীতি রক্ষার প্রধান দায়িত্ব তো ইমামের। কথা তো ছিল তিনিই মানুষকে শেখাবেন, উল্টো তিনি কীভাবে নিজের জেদ ধরে রেখে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে বিপক্ষের লোকদের ওপর হামলা করলেন।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী হলো- মুসলমানকে হত্যা করা আল্লাহকে অস্বীকার করার মতো গুরুতর অপরাধ। একজন মানুষকে হত্যা করা যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করা। আর একজন মানুষের জীবন বাঁচানো যেন গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করা।
সত্যিকারের ইসলাম অনুগত কেউ কাউকে খুন করতে পারে না। এর সঙ্গে যে বা যারা জড়িত, তারা হয়ত ইসলামের সঠিক শিক্ষা পায়নি অথবা ইসলামের সঠিক শিক্ষা তারা নিজ জীবনে প্রতিফলিত করার গুরুত্ব অনুভব করেনি। যে ভাবেই হোক তাদের অবস্থান ইসলাম থেকে অনেক অনেক দূরে।
আমাদের দেশের মসজিদ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবহেলা আছে। এর অন্যতম হলো- মসজিদের সভাপতি ও সেক্রেটারি পদের জন্য ব্যক্তি শিক্ষা, জ্ঞান ও নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আবার ইমাম পদের জন্য খোঁজা হয় সবচেয়ে কম পয়সা লোক। এ ক্ষেত্রে তার শিক্ষা, চরিত্র, নৈতিকতা, আত্মশুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, মেধার মতো গুণাবলীকে সেভাবে যাচাই করা হয় না। এটাও কাম্য নয়।
মসজিদের কমিটির লোকজনের উচিৎ সরাসরি নিজেরা ইমাম নির্বাচন না করে, নিকটতম গ্রহণযোগ্য সিনিয়র আলেমদের তত্ত্বাবধানে ও পরামর্শে ইমাম নির্বাচন করা।
মসজিদের কমিটি গঠন ও ইমাম বাছাইয়ে এই সুনীতির চর্চা হলে এ ধরণের অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যাবে।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৭
এমএইউ/