ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

জাকাত হিসেবে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ সুন্দর পদ্ধতি নয়

মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৮ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
জাকাত হিসেবে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ সুন্দর পদ্ধতি নয় জাকাত হিসেবে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ সুন্দর পদ্ধতি নয়

জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। সুষ্ঠু জাকাত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ইসলামি রাষ্ট্রের বিশেষ এক রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।

জাকাতের সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাঝে নিহিত আছে ইসলামি রাষ্ট্রের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, ইসলামি সমাজের মানবিক সৌন্দর্য এবং ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামের স্থায়ীত্ব ও হেফাজতের আর্থিক সহায়তা।

তাই জাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে নিজের খেয়াল খুশিমতো অথবা বাপ-দাদা ও সমাজের রেওয়াজ মতো আদায় করা উচিৎ নয়।

বরং জাকাতের মূল চেতনা অক্ষুণ্ন রেখে জাকাত বিতরণ করা উচিৎ।

বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ধনীদের জাকাত বিতরণের প্রসিদ্ধ পদ্ধতি হলো- জাকাতের টাকা দিয়ে শাড়ি ও লুঙ্গি কিনে তা বিতরণ করা। অনেক সময় জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের জন্য মাইকিং করে কিংবা ঘোষণা দিয়ে লোক জমা করা হয়। সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা ভিড়ের কারণে প্রাণহাণীর ঘটনাও ঘটছে।  

এভাবে জাকাত বিতরণের রেওয়াজ চালু হওয়ার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের বস্ত্র উৎপাদন এবং বিপননেও চালু হয়েছে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি নামে আলাদা একটি ধারা।  জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি নামে বস্ত্র কারখানাগুলোতে উৎপাদিত হয় নেহাতই নিম্নমানের স্বল্পমূল্যের শাড়ি ও লুঙ্গি। এ গুলো জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি নামে পাইকারি ও খুচরা দোকানে বেচাকেনা হয়। অনেক দোকানি রমজান মাসে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে- এখানে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি পাওয়া যায়।

এ পদ্ধতি অনেকটাই হাস্যকর, এমনকি উপহাসের পর্যায়েরও। যা জাকাতের সৌন্দর্যকে শুধু নষ্টই করেনি বরং জাকাতকেই প্রশ্নযুক্ত ও বিতর্কিত করে ফেলে। অমুসলিমদের কাছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে জাকাত সম্পর্কে ও ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেয়।

জাকাতের বিতরণের একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহর নির্দেশ মেনে তার সন্তুষ্টি অর্জন করা। আর জাকাত বিতরণের প্রথম লক্ষ্য ইসলামের বিস্তৃতি সাধন ও হেফাজত করা এবং দ্বিতীয় লক্ষ্য মুসলিম সমাজের দারিদ্র বিমোচন করা। গরিব মুসলমানদের অর্থনৈতিক অভাব দূর করা।

মাইকিং করে গরিব মুসলমানদের ভিক্ষার লাইনে দাঁড় করিয়ে মাথাপিছু কমদামের নিম্নমানের শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করার দ্বারা উক্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কোনোভাবেই অর্জিত হয় না।

একজন গরিব মুসলমানের অথবা একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবারের অনেক ধরণের অভাব থাকে। খাদ্যের অভাব থাকে, বস্ত্রের অভাব থাকে, চিকিৎসার অভাব থাকে, বাসস্থানের অভাব থাকে, সন্তানদের শিক্ষার অভাব থাকে। এখন শুধু শাড়ি ও লুঙ্গি দিলে দরিদ্র পরিবারের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার অভাব অপূরণ থেকে যায়। আর বস্ত্রের অভাবও সঠিকভাবে পূরণ হয় না। কেননা গ্রহীতা পরিবারের হয়তো শাড়ি-লুঙ্গির অভাব না থেকে অন্য ধরণের বস্ত্রেরও অভাব হতে পারে। উপরন্তু আপনি যে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করছেন তা হয়তো তার জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে।

একজন জাকাত গ্রহীতা দরিদ্র ব্যক্তি যদি সমাজের ২০ জন জাকাতদাতা থেকে ২০টি শাড়ি পায় তাহলে সে এ ২০টি শাড়ি দিয়ে কী করবে? সে হয়তো সারা বছরের পরার জন্য সর্বোচ্চ ২টি রেখে দেবে। বাকিগুলো তাকে বিক্রিই করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি যে শাড়িটি দোকান থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করে তাকে দিয়েছেন, আপনার জাকাত গ্রহীতা গরিব মুসলমান আপনার দেওয়া শাড়িটি নিজের জন্য অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় যখন বিক্রি করবে তখন সে পাবে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়াল?

জাকাত পাওয়ার কথা ছিল গরিব মুসলমানের। কিন্তু শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের ভুল পদ্ধতির কারণে জাকাতের শতকরা ৩৩ ভাগ টাকা চলে গেল সরাসরি বস্ত্র বণিকের হাতে। আর গরিব মুসলমান পেল বিতরণকৃত অর্থে মাত্র ৬৬ শতাংশ। কৌশলে বা অজ্ঞতায় গরিবকে ৩৩ ভাগ ঠকানো হলো।  

জাকাত সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী হলো- এটা গরিবের ওপর ধনীর অনুদান নয়। বরং এটা গরিবের ন্যায্য পাওনা। কোনো ভদ্র, রুচিশীল, সম্ভ্রান্ত মানুষ পাওনাদারকে ডেকে নিয়ে এসে পাওনা পরিশোধ করে না। বরং নিজে পাওনাদারের কাছে যেয়ে তার সমুদয় পাওনা বুঝিয়ে দেয়। আর এটাই ভদ্রতা ও ব্যক্তিত্বের পরিচয়।

জাকাতের দ্বিতীয় লক্ষ্য- মুসলিম সমাজের দারিদ্র্য বিমোচন। বছর বছর কয়েকটি শাড়ি ও লুঙ্গি পেয়ে কোনো গরিবের দারিদ্র্য বিমোচন হয় না- হওয়া সম্ভবও না। তাই অনেকজনকে একটি করে শাড়ি বা একটি লুঙ্গি না দিয়ে একটি পরিবারকে কিভাবে উপার্জনের উপর দাঁড় করানো যায়, স্বনির্ভর করে দেওয়া যায় সেভাবে জাকাত বিতরণ করাই শ্রেয়।

আপনি এ বছর যাকে জাকাত দেবেন তার যেন আর আগামী বছর জাকাত গ্রহণের প্রয়োজন বা অবস্থা না থাকে।

অনেক সময় একটি পরিবারের জন্য শাড়ি বা লুঙ্গির চেয়ে অনেক বেশি অভাব থাকে চিকিৎসার বা মেয়ে বিয়ের বা সন্তানের শিক্ষার। শাড়ি-লুঙ্গি এ ধরণের পরিবারের জন্য উপহাস বৈ কিছু নয়। তাই শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে জাকাত গ্রহীতার আসল প্রয়োজনটি পূরণ করে দিন।

অনেক পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ থাকে না। ঘরের কর্তা হয়তো স্থায়ী বিকলাঙ্গ বা স্থায়ী দূরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী। এ ধরণের পরিবারে অভাবের কোনো অন্ত থাকে না। শাড়ি-লুঙ্গি এদের প্রয়োজনের এক আনা হয়তো পূরণ করবে, কিন্তু বাকীটা? তাই জাকাত হিসেবে শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে এ ধরণের মুসলিম পরিবারকে সরাসরি জাকাতের অর্থ বেশি পরিমাণে দিন। যেন তারা নিজেরা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারে।  

জাকাতকে নিজের ইমেজ ও খ্যাতি বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিবেদন করুন। ইসলামের স্বার্থ রক্ষায় ও গরিবের অভাব মোচনের জন্য আন্তরিক হোন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন আমিন।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৯ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।