ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০ শাবান ১৪৪৬

আইন ও আদালত

শিশু আয়ানের মৃত্যু: রুল শুনানি ৫ মার্চ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৫
শিশু আয়ানের মৃত্যু: রুল শুনানি ৫ মার্চ হাইকোর্ট

ঢাকা:  রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুলে ইউনাইটেড হাসপাতালে খতনা করার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হওয়া শিশু আয়ানের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার প্রশ্নে রুলের ওপর শুনানির জন্য আগামী ৫ মার্চ দিন রেখেছেন হাইকোর্ট।  

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার (২৯ জানুয়ারি) এদিন নির্ধারণ করেন।

 

আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। হাসপাতালের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।   

২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনা করানোর জন্য আয়ানকে সাঁতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান অভিভাবকরা। খতনা শেষ হওয়ার পর আয়ানের জ্ঞান না ফেরায় তাকে সেখান থেকে পাঠানো হয় গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে পিআইসিইউতে (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এর সাতদিন পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম।

একই বছরের ১৫ জানুয়ারি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে রুলে আয়ানের পরিবারকে কেন পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।

এ আদেশ অনুসারে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. পরিমল কুমার পালের সই করা ১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই প্রতিবেদনকে এক ধরনের আইওয়াশ বলে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্ট। আর প্রতিবেদনের সুপারিশকে হাস্যকর উল্লেখ করেন উচ্চ আদালত। পরে গত ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।  

৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম মাকসুদুল আলমকে। সচিব হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।

এ কমিটির প্রতিবেদন সম্প্রতি হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। হাইকোর্ট প্রতিবেদনটি নথিভুক্ত করে রেখেছেন।   

প্রতিবেদনে ‘বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত মতামত ও সিদ্ধান্ত’ অংশে বলা হয়, বিশ্লেষণের আলোকে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির সদস্যরা মনে করেন যে, শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী। কেননা এ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি একটি নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান। এ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকায় এটি বৈধভাবে চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, অস্ত্রোপচারের আগে নেবুলাইজ করা এবং অস্ত্রোপচার পরবর্তী ঝুঁকি সম্পর্কে চিকিৎসকদের টিমের উচিত ছিল শিশু আয়ানের বাবা বা অভিভাবকদের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া।

তৃতীয়ত, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সৈয়দ সাব্বির আহম্মদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল এবং তাকে সহযোগিতা করার জন্য সহকারী প্রয়োজন ছিল।  

চতুর্থত, কমিটি মনে করে যে, সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করার পরিবেশ যেমন ছিল না, তেমনি অস্ত্রোপচার পরবর্তী জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল না।  

উপরন্তু, গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় আয়ানের বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ডাক্তার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যবহার ছিল রূঢ়। সবশেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকার বিল পরিশোধ করে আয়ানের মরদেহ নিয়ে যেতে বলা ছিল অমানবিক।

তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়, ১. সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। ক্ষতিপূরণের একটি অংশ আয়ানের বাবা-মাকে দেওয়া এবং অন্য অংশ দিয়ে দুস্থ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার জন্য কমিটির সদস্যরা সুপারিশ করেছেন।

২. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং শিশু আয়ানের মৃত্যুর জন্য ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

৩. ডাক্তার তাসনুভা মাহজাবীন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সৈয়দ সাব্বির আহম্মদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলো।

৪. চিকিৎসা সংক্রান্ত লিখিত সম্মতিপত্রটি বাংলায় বড় বড় অক্ষরে স্পষ্ট ও বোধগম্যভাবে লিখতে হবে, যাতে রোগীর বাবা-মা বা অভিভাবকরা সেটি সহজে পড়তে পারেন এবং চিকিৎসা ও তার পরবর্তী ফলাফল সম্পর্কে জেনে-বুঝে লিখিত সম্মতিপত্র স্বাক্ষর করতে পারেন। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সমগ্র বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য একটি ‘ইউনিফর্ম’ বা একই ধরনের সম্মতিপত্র প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ ও সুপারিশ করা হলো।

৫. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া যে-সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, সেগুলো খুঁজে বের করে অবিলম্বে সেখানে চিকিৎসা কর্মকাণ্ড বন্ধ করা এবং সেসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সাতটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সেগুলো হলো- 

১. বাংলাদেশের সব মানুষের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনের সংস্কার ও পরিমার্জন করার সুপারিশ করা হলো।  

২. বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রেফারেল পদ্ধতির মাধ্যমে নিচ থেকে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে। একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানকে দেখানোর পরে তিনি যদি কোনো রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করেন, তাহলে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। এতে চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হবে এবং রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে রোগীর চাপ কমবে।  

৩. অপরিকল্পিত, মানহীন (ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ) বন্ধ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।  

৪. এন্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।  

৫. একমাত্র বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) কর্তৃক নিবন্ধিত ব্যক্তির মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।  

৬. বাংলাদেশের সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বৈশ্বিকভাবে অনুসারিত জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ও সেটি যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য সুপারিশ করা হলো।  

৭. চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাসহ অন্যান্য ব্যক্তিকে তাদের যোগ্যতা অনুসারে ক্ষেত্রমতো প্রণোদনা দেওয়া ও ভালো প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা (গুড ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস) উৎসাহিত করার জন্য সুপারিশ করা হলো।  

খতনা করার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হওয়া শিশু ‘আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী’ করেছে এ ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি।  

আর দায়ী হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। সেই ক্ষতিপূরণের একটি অংশ আয়ানের বাবা-মাকে এবং অন্য অংশ দুস্থ শিশু ও কিশোরদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার সুপারিশ করেছে কমিটি।

কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

রোববার রিটকারী আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম জানান, বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন রেখেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৫
ইএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।