লালমনিরহাট: ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করে বিজয় আনন্দে মেতে ওঠে রেলওয়ের বিভাগীয় শহর লালমনিরহাট জেলার মানুষ।
প্রবীণ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনায় জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণায় বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ মাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করতে উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে।
২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭ মার্চ দুপুরে লালমনিরহাটের মুক্তিকামী মানুষ মিছিল নিয়ে রেলওয়ের আপইয়ার্ড কলোনি পার হওয়ার সময় পাকিস্তানিদের সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। পাকিস্তানি ইপিআর জিয়াউল হকের গুলিতে শহীদ হন শাহজাহান। প্রথম শহীদ শাহজাহানকে তার বাড়ির পাশে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাটে ২৯জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেলেও স্বাধিনতার ৫১ বছরেও অসংখ্য শহীদের মরদেহের সন্ধান মেলেনি।
পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করতে গঠিত হয় রাজাকার আল বদর, আল সামস। তারাও পাক সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। মা বোনদের সম্ভ্রমহানী করে প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর আল বদর, আল সামস তথা রাজাকাররা।
রেলওয়ের শহর লালমনিরহাটের নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন ও হত্যা করে তৎকালিন ডিআরএম ভবনের পেছনের ডোবায় মরদেহ ফেলে রাখে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা। পরবর্তীকালে ডিআরএম ভবনের পেছনটা গণকবর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংরক্ষণ করা হয় ৭১ এর সেই গণকবর। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলীসহ মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে জাতি আজও স্মরণ করে বীর শহীদদের।
মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশে মোট ১১টি সেক্টরের মধ্যে লালমনিরহাট অঞ্চল ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অধিনে। দেশের অভ্যন্তরে থাকা একমাত্র ৬ নম্বর সেক্টরটি ছিল পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এম খাদেমুল বাশার। তার দক্ষ নেতৃত্বে ও সাহসী পদক্ষেপে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে এ সেক্টর পরিদর্শনে আসেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর পদচারনায় আরও সাহসী হয়ে ওঠে ৬ নম্বর সেক্টরের সম্মিলিত বাহিনী।
২৮ ও ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রবল আক্রমণ চালালে ৩০ নভেম্বর জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার বড়বাড়ি আইরখামারে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী।
প্রবল আক্রমণের মুখে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনী বিতারিত হলেও পরদিন পুনরায় বড়বাড়ি আইরখামারে আক্রমণ চালায়। জ্বালিয়ে দেয় বেশ কিছু ঘর-বাড়ি। ৫ ডিসেম্বর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভোরে বিকট শব্দে তিস্তা রেল সেতু উড়িয়ে দিয়ে শেষ বারের মত লালমনিরহাট ত্যাগ করে রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। আর তাদের দোসর রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তির আনন্দে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে জেলার আমজনতা। জয় বাংলা স্লোগানে বিজয় মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো লালমনিরহাট। দেশের আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে জাতীয় পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এ জেলার কৃতী সন্তান শহীদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
৬ নম্বর সেক্টরের বড়বাড়ি আইরখামার এলাকায় শেষ সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে আদিতমারীর দুর্গাপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুব আলী বাংলানিউজকে জানান, ৪ ডিসেম্বর রাতভর যুদ্ধ করে বড়বাড়ি থেকে পাক সেনাদের বিতারিত করা হয়। কিন্তু পরদিন পুনরায় তারা রাজাকারদের আহ্বানে বাঙালির ওপর আক্রমণ করলে ৫ ডিসেম্বর রাতে আবারো তুমুল বেগে আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রাতভর আক্রমণে পরদিন ভোরে পাক সেনারা পালিয়ে যায়। ওই দিন বেশ কিছু সহযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে পিপাসার্ত হয়ে মানুষের মলযুক্ত মাঠের পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বাংলানিউজকে জানান, যথাযোগ্য মর্যাদায় মুক্তদিবস পালন করতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। আনন্দ র্যালি, আলোচনা সভাসহ নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জেলাবাসী দিবসটি উদযাপন করবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০২২
আরএ