খুলনা থেকে: গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর উদ্যোগে বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ গণহত্যা: পরিণাম, প্রতিরোধ ও ন্যায়বিচার শীর্ষক দুদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিন এবং উদ্বোধনী আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে।
খুলনার শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কে এম খালিদ বলেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা দুনিয়ার গণহত্যা বিষয়ক চিন্তাচর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের চিন্তাচর্চার মেলবন্ধন ঘটানো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার সঙ্গে গত শতকের অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত গণহত্যার মিল ও অমিল রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের গণহত্যা বৈশ্বিক ইতিহাসেরও অংশ। গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য আমাদের যে লড়াই তাকে বেগবান করতে হলে এ ধরনের তুলনামূলক আলোচনা গুরুত্ব বহন করে। ফলে গণহত্যা জাদুঘর আয়োজিত এ সম্মেলন বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্যবাহী।
সভাপতির বক্তব্যে মুনতাসীর মামুন গণহত্যা জাদুঘর গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, গণহত্যা জাদুঘর কেবল নিদর্শন প্রদর্শনের কাজই করছে না বরং মাঠ পর্যায়ে যে গবেষণা চালাচ্ছে সেটা বদলে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার গতিপথ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা-নির্যাতন। একের অধিক মানুষ হত্যাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে গণহত্যা হিসেবে। নির্যাতনের অন্তর্গত শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও দেশ ত্যাগে বাধ্য করা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বগাথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং তা স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো একটি দেশে এত অল্প সময়ে এত মানুষ হত্যা করা হয়নি। যদিও আমরা বলি ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন কিন্তু মনে হয় সংখ্যাটি তারও বেশি। গণহত্যা, বধ্যভূমি, নির্যাতন মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে একেবারে নেই তা নয় কিন্তু সেভাবে গুরুত্ব এর ওপর দেওয়া হয়নি। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের ব্যাপারটি আড়ালে পড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যার ভয়াবহতা ও তীব্রতা বোঝার একটা ভালো উপায় হচ্ছে গত শতকে সারা দুনিয়াতে সংঘটিত গণহত্যাগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করা। তাহলে যেমন বাংলাদেশ গণহত্যার তীব্রতা বোঝা সম্ভব, তেমনি গণহত্যা স্বীকার-অস্বীকারের রাজনীতিও পরিষ্কারভাবে বোঝা সম্ভব। আর্মেনিয়া থেকে শুরু করে রুয়ান্ডা পর্যন্ত বিশ শতকে অজস্র গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে তাও নয় কিন্তু গবেষকরা সেগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। কেবল গণহত্যায় এত বেশি সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছেন যে, গত শতককে গবেষকগণ ‘সেঞ্চুরি অব জেনোসাইড’ বলে অভিহিত করেছেন।
মুনতাসীর মামুন বলেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে স্বৈরচারী, ফ্যাসিবাদী ও সামরিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গণহত্যা ঘটানোর প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে নাগরিক সমাজের মধ্যে গণহত্যা প্রতিরোধে নানা ধরনের এক্টিভিজমও লক্ষণীয়। গণহত্যা বিরোধী প্রচারণাতেও দেশ-বিদেশের নাগরিক সমাজের একাংশ সক্রিয় থেকেছেন। তারা সিনেমা বানিয়েছেন, উপন্যাস লিখেছেন, গবেষণা করেছেন, জাদুঘর ও আর্কাইভ গড়ে তুলেছেন। এ সক্রিয়তার পেছনে লুকিয়ে আছে বিশ্বের সচেতন অংশের কিছু অভিন্ন স্বপ্ন, গণহত্যা প্রতিরোধ করা, গণহত্যার শিকার জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং আক্রান্তদের মানসিক ও শারীরিক আঘাতকে সুস্থ করে তোলা।
আয়োজনে বিভিন্ন সেশনে প্রবন্ধ পাঠ করেন অধ্যাপক সঞ্জয় কে ভরদ্বাজ, ভারত; ড. স্মৃতি এস পাটনায়েক, ভারত; ড. মুর্শিদা বিনতে রহমান, বাংলাদেশ; ড. তিস্তা দাস, ভারত; মামুন সিদ্দিকী, বাংলাদেশ; ড. লোপামুদ্রা বাজপেয়ী, ভারত; অধ্যাপক পবিত্র ভরদ্বাজ, ভারত; অধ্যাপক কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারত; ড. শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, ভারত; ড. চৌধুরী শহীদ কাদের, বাংলাদেশ; ড. শম্পা ঘোষ, পুনম মুখার্জি, ড. সুভাষ চন্দ্র সুতার।
সম্মেলন উপলক্ষে বেলা ১১টায় মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর্যের শিল্পকর্ম এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। এ প্রদর্শনী চলবে দুদিনব্যাপী। পাশাপাশি গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়েছে।
বিভিন্ন কর্ম-অধিবেশনে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন, অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক, চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, কবি তারিক সুজাত।
আগামী শনিবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুদিনব্যাপী এ সম্মেলন শেষ হবে। এরপর বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীয় অষ্টম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এ দুদিনে (৯-১০ ডিসেম্বর) দেশ-বিদেশের প্রায় ২০ জন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। সম্মেলনের বিভিন্ন কর্ম অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অর্থনীতিবিদ, সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২২
এইচএমএস/আরবি